Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গোষ্ঠী-বিবাদ ঠেকাতে এ বার সক্রিয় মমতা

রাজ্যে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পথে নন্দীগ্রামের জেলাই ছিল অন্যতম মূল সোপান। সেই ২০০৮ সালে পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা পরিষদ জিতে তৃণমূলের ক্ষমতায় আরোহনের দৌড় শুরু।

স্বপন সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০৩:৩৪
Share: Save:

রাজ্যে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পথে নন্দীগ্রামের জেলাই ছিল অন্যতম মূল সোপান। সেই ২০০৮ সালে পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা পরিষদ জিতে তৃণমূলের ক্ষমতায় আরোহনের দৌড় শুরু। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে সেই জেলাতেই শাসক দলকে ধারাবাহিক ভাবে অস্বস্তিতে রেখেছে গোষ্ঠী-বিবাদ। বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এ বার সেই জেলার গোষ্ঠী-লড়াই নিয়ন্ত্রণে আনতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

বিধানসভা ভোটের এখনও অন্তত মাসদশেক দেরি থাকলেও শাসক দলের অন্দরে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে নানা শিবিরই। গোষ্ঠী-রাজনীতির জন্য খ্যাত পূর্ব মেদিনীপুরে এই নিয়ে তৎপরতা আরও বেশি। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, কোলাঘাট থেকে হলদিয়া এলাকার মধ্যে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়কদের আর যাতে প্রার্থী করা না হয়, সেই মর্মে বার্তা পাঠানো হয়েছিল তৃণমূল ভবনের কাছে। কিন্তু সেই আর্জিতে কান না দিয়ে তৃণমূল নেত্রী তাঁদের মধ্যে তিন বিধায়ককেই নিজেদের এলাকায় কাজে নেমে পড়তে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন বলে শাসক দল সূত্রের খবর। একমাত্র হলদিয়ার বিধায়ক শিউলি সাহাকে নিয়েই সংশয়ী দলের একাংশ। কারণ, বাকি বিধায়কদের মধ্যে শিউলিকে তাঁর বিধানসভা এলাকার দলীয় কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়নি। দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের অনুগামী হিসাবে হলদিয়ার বিধায়কের তকমাই শেষ পর্যন্ত তাঁর ফের টিকিট পাওয়ার পথে অন্তরায় হতে পারে বলে তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য। যদিও দলেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, জেলা বা স্থানীয় নেতৃত্বের বড় অংশের মতামতকে অগ্রাহ্য করে কাউকে বিধানসভায় প্রার্থী করলে ভোটে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা প্রবল। পূর্ব মেদিনীপুরে ইতিমধ্যেই যে আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছে!

অধিকারী পরিবারের সঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরে অখিল গিরি শিবিরের বিবাদের কথা তৃণমূলে বহুচর্চিত। বিধানসভার প্রার্থী নিয়ে টানাপড়েনের বিষয়ে দুই শিবিরই অবশ্য নিজেদের প্রকাশ্যে জড়াতে নারাজ। জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি অখিলবাবু এই নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে চাননি। আর তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, ‘‘এখনও নির্বাচনের দেরি আছে। প্রার্থী পদ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তিনিই শেষ কথা বলবেন।’’

গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের জেরে পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, তার জন্য দলনেত্রীর আরও কিছু ‘সক্রিয়তা’র নমুনা মিলছে তৃণমূল শিবির থেকে। জেলার গোষ্ঠী রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে কোনও কোনও বিধায়ককে তাঁদের বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যানের পদ দেওয়া নিয়েও বিরোধ পেকে উঠেছিল। কিন্তু তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছেন, দলের নির্দেশ মানতে হবে সকলকেই। সেইমতোই হলদিয়া বাদে জেলার বাকি ১৫টি বিধানসভা ক্ষেত্রে বিধায়কদেরই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। পুরভোটের পরে তমলুক পুরসভার ১৩ জন দলীয় কাউন্সিলর এলাকার বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্রের বিরুদ্ধে স্মারকলিপি জমা দেন শীর্ষ নেতাদের কাছে। তাঁদের দাবি ছিল, সৌমেনবাবুকে তমলুক বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান করা যাবে না। তার পাল্টা বিধায়কের হয়ে দলীয় সমর্থকদের একাংশ একই ভাবে সেই নেতৃত্বের কাছে সৌমেনবাবুকে চেয়ারম্যান করার দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬ জন বিধায়কের মধ্যে ১৫ জনকেই বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান করে গোষ্ঠী-রাজনীতির বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

শুধু তা-ই নয়, খানিকটা নজিরবিহীন ভাবেই তমলুক বিধানসভার অর্ন্তগত মাতঙ্গিনী ব্লকের সভাপতি করা হয়েছে মন্ত্রী সৌমেনবাবুকে। এক জন মন্ত্রী একটি ব্লকের সভাপতি হচ্ছেন, এমন নজির বিশেষ নেই! শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশিকা মেনেই এ বার ২১ জুলাই শহিদ সমাবেশের প্রস্তুতি হিসাবে দীঘায় ২ জুলাই বৈঠক ডেকেছেন শিশির অধিকারী। যে এলাকা অখিলবাবুর বিধানসভা কেন্দ্রে পড়ে। ২১শের প্রস্তুতিতে যাতে গোষ্ঠীর ছায়া না পড়ে, তাই এমন উদ্যোগ বলে তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য।

এরই পাশাপাশি, গোষ্ঠী রাজনীতিকে নস্যাৎ করতে তমলুক বিধানসভা এলাকার স্থানীয় এক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেও কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, ক্ষমতা ব্যবহার করে ওই নেতা ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠছিলেন। তাঁর দল-বিরোধী কাজের পিছনেও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের অঙ্ক কাজ করছে বলে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে খবর পৌঁছেছিল। তার পরেই জেলা সভাপতি এবং বিধায়কদের উপস্থিতিতে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে কিছু সিদ্ধান্ত ‘চাপিয়ে দেওয়া’ হলে পরবর্তী কালে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা কি থেকে যাচ্ছে না? জেলার এক প্রথম সারির তৃণমূল নেতার বক্তব্য, ‘‘এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। কারণ, আমাদের দলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। কে কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE