Advertisement
E-Paper

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব এনে ক্ষোভ বাড়ালেন মমতা

কলেজের অধ্যক্ষ মার খেলে তিনি বলেন, ছোট্ট ঘটনা। শহরের রাজপথে ধর্ষণ হলে তিনি বলেন, সাজানো ঘটনা। সালকিয়ার নিহত প্রতিবাদী অরূপ ভাণ্ডারীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “দু’টো গ্রুপের গোলমাল!” সেটাই অরূপের মৃত্যুর কারণ বলে তাঁর দাবি। আর, ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ? মমতার সটান জবাব, “কোন মেয়েকে টিজ করা হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে তো! সেটা তো এখনও পাওয়াই যায়নি!”

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৭

কলেজের অধ্যক্ষ মার খেলে তিনি বলেন, ছোট্ট ঘটনা। শহরের রাজপথে ধর্ষণ হলে তিনি বলেন, সাজানো ঘটনা। সালকিয়ার নিহত প্রতিবাদী অরূপ ভাণ্ডারীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “দু’টো গ্রুপের গোলমাল!” সেটাই অরূপের মৃত্যুর কারণ বলে তাঁর দাবি। আর, ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ? মমতার সটান জবাব, “কোন মেয়েকে টিজ করা হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে তো! সেটা তো এখনও পাওয়াই যায়নি!”

অর্থাৎ? তরুণীদের নিগ্রহ এবং অরূপের প্রতিবাদী কণ্ঠকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে গোটা ঘটনাটাই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিণাম বলে চালাতে চেয়েছেন। ফল? এলাকাবাসীদের অসন্তোষ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করা এবং রাজ্যবাসীর কাছে প্রশাসক হিসেবে বার্তা দেওয়ার যে উদ্দেশ্য নিয়ে মমতা এ দিন অরূপদের বাড়ি এসেছিলেন, তাঁর নিজের মুখের কথাই সেই চেষ্টায় জল ঢেলে দিল। বাড়িয়ে দিল জনরোষের আঁচ। এতটাই যে, এলাকার তৃণমূল বিধায়ক অশোক ঘোষকেও এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করতে হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরে ক্ষুব্ধ বিধায়ক বলেন, “কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ব্যাপার নয়। দোষীদের ধরতে কেন এত দেরি হচ্ছে তা-ও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। গোটা ঘটনায় পুলিশ যে ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হতে বাধ্য।” বিধায়কের ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, এলাকার এক তৃণমূল নেতার সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগাযোগের যে অভিযোগ উঠেছে তা নিয়েও দলের মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অশোকবাবু। তৃণমূলের কাছের লোক বলে পরিচিত অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কোন প্রেক্ষিতে কী বলেছেন, তা নিয়ে মন্তব্য করব না। তবে প্রতিবাদী যুবকের মৃত্যু ঠেকাতে পুলিশের আরও তৎপর হওয়া উচিত।” লক্ষণীয় রুদ্রনীলও ‘প্রতিবাদী’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

অথচ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব হাজির করার আগে মুখ্যমন্ত্রী অরূপের বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। অরূপের ভাই অমরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দফতরে পাকা চাকরির নিয়োগপত্রও। এলাকার তৃণমূল নেতারা আশা করতে শুরু করেছিলেন, এ বার হয়তো পরিবার ও এলাকার মানুষের ক্ষোভ কমানো যাবে। কিন্তু অরূপদের ঘর থেকে বাড়ির উঠোনে বেরিয়েই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা বলায় ফের আগুনে ঘি পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরেই অরূপের ভাই দাবি করেন, “ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করতে গিয়েই দাদাকে খুন হতে হয়েছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা একেবারেই ঠিক নয়।” অরূপের দাদু নীলমণি দলুইও চিৎকার করে বলতে থাকেন, “কীসের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রী গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা বললেন?” অরূপের এক বন্ধু বলেন, “খোদ মুখ্যমন্ত্রীই যদি বিষয়টাকে এ ভাবে লঘু করে দেন, তা হলে আর দোষীদের শাস্তি পাওয়ার ব্যাপারে আমরা কী ভাবে আশ্বস্ত হব?”

এ দিন অরূপের মৃত্যু নিয়ে ঠিক কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী? তাঁর বক্তব্য, “দু’টো গ্রুপের মধ্যে গোলমাল হয়েছে। ছেলেটি খুবই ভাল ছিল। পুলিশকে বলেছি, যেখানেই পালাক দোষীদের গ্রেফতার করতে হবে।”

অথচ অরূপের মৃত্যুর পর থেকেই পুলিশি ব্যর্থতা এবং দুষ্কৃতীদের সঙ্গে এলাকার এক তৃণমূল নেতার যোগাযোগের অভিযোগ এনে এলাকার মানুষ ফুঁসছিলেন। পরিস্থিতি সামলাতে কর্মীদের জড়ো করে রীতিমতো ক্যাম্প করে এলাকার দখল নিয়েছিলেন তৃণমূল নেতারা। অরূপকে তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করে ফেস্টুনও টাঙিয়েছিলেন। তাতে জনরোষ আরও বেড়েছিল। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আঁচ করে সেই ফেস্টুন খুলতে বাধ্য হয় স্থানীয় তৃণমূল। কিন্তু এলাকার দখল ছাড়েনি তারা। তবে মানুষ যে তাদের পাশে নেই, সেটা চাপা থাকছিল না। এই অবস্থায় মঙ্গলবার এলাকার নেতারা প্রথমে অরূপের ভাইকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন। অরূপের পরিবার জানিয়ে দেয়, আগে খুনিরা ধরা পড়ুক, তার পরে চাকরির প্রশ্ন।

এক দিকে সারদা এবং খাগড়াগড়ের মতো ঘটনা, অন্য দিকে রাজ্য জুড়ে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনায় শাসক দলের নাম জড়িয়ে পড়া তৃণমূলের উপরে রাজ্যবাসীর অনাস্থা দিনদিন বাড়ছে। তার উপরে পরপর নেতা-মন্ত্রীরা জেরার মুখে পড়া মায় গ্রেফতারও হয়ে যাওয়ার পরে মমতার সরকার এমনিতেই বিপর্যস্ত। দলের মধ্যেও একের পর এক বিদ্রোহী কণ্ঠ মাথা তুলছে। এই পরিস্থিতিতে সালকিয়ার ঘটনায় জনরোষ নিয়ন্ত্রণেরবাইরে চলে যাক, এটা চাইছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। তাই তিনি নিজে সক্রিয় হন। মঙ্গলবারই অরূপদের বাড়ি আসার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু এলাকায় শীতলাপুজোর যানজটের জন্য তাঁকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে হয়। তার পরে অরূপদের বাড়িতে ফোন করে কথা বলেন তিনি। দোষীদের ধরার আশ্বাসও দেন। পাশে থাকার বার্তা দিতে তিনি বুধবার দুপুর একটা নাগাদ অরূপদের বাড়িতে আসেন। প্রাথমিক ভাবে অরূপের পরিবার ও এলাকাবাসীরা মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে কিছুটা শান্ত হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী দোষীদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানান, অরূপকে ‘ভাল ছেলে’ আখ্যাও দেন। কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব খাড়া করামাত্র সবটাই ওলোটপালোট হয়ে যায়।

পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে কেন এমন বিতর্ক তৈরি করে এলেন মুখ্যমন্ত্রী? এলাকার তৃণমূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, মমতা বিষয়টি লঘু করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যে ভাবে পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণকে ‘সাজানো ঘটনা’ বা অন্য অনেক ঘটনাকেই ‘ছোট ঘটনা’ অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। কারও আবার ধারণা, নিহত যুবককে তৃণমূল কর্মী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, তা হালে পানি পায়নি। সেই কারণেও বিষয়টিকে এখন তৃণমূলের বাইরে নিয়ে এসে স্থানীয় দুই গোষ্ঠীর গণ্ডগোল বলে চালাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই জন্যই যে তরুণীদের নিগ্রহের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন অরূপ, তাঁদের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।

মমতা ওই তরুণীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন ঠিকই। কিন্তু ঘটনা হলো, গত সোমবার অরূপের মৃত্যুর পরেই তাঁদের দু’জন বিবিবাগানে এসেছিলেন। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তো বটেই, এমন কী সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন তাঁরা। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে ওই তরুণীদের খুঁজে বার করার দায়িত্ব কার? প্রশাসন কেন সে দায়িত্ব নিচ্ছে না? এ ক্ষেত্রেও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করেছেন এলাকাবাসী। তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কলকাতা পুলিশের সার্জেন

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, “মুখ্যমন্ত্রীর কথার মানে দাঁড়াচ্ছে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খুন হলে যেন সেটা কোনও অপরাধই নয়! যারা ওই যুবককে খুন করল, তাদের ধরার ব্যাপারে প্রশাসনের ভূমিকা কী?” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। একটি ছেলে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী বরং বলুন, কেন খুনিদের ধরা হচ্ছে না!” বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর আশঙ্কা, “উনি শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। কালই হয়তো উনি পুলিশকে বলবেন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মৃত্যু বলে রিপোর্ট দিতে।”

mamata arup bhandari salkia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy