বঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনই যে আপাতত তাঁর রাজনীতির হাতিয়ার, ফের তা স্পষ্ট করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বার্তা, ‘‘সব দেবেন, নিজের ঠিকানা, ভাষা ও অস্তিত্ব দেবেন না। অস্তিত্ব চলে গেলে সব যায়।’’ একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ডাক দিয়েছেন, না জেনে কেউ যেন ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার ফর্ম পূরণ না করেন। তা হলে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ যেতে পারে। বিজেপি অবশ্য পাল্টা দাবি করেছে, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী-সহ ভুয়ো ভোটার বাদ যেতে পারে বলে আতঙ্কেই মুখ্যমন্ত্রী প্রতি দিন বিষোদগার করছেন।
ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার বিশ্ব আদিবাসী দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, ‘‘কেউ যদি বলে আমাদের এখানে ফর্ম পূরণ করুন, না জেনে করবেন না। আপনার ডিটেল্স (তথ্য) নিয়ে গিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে দেবে! তার পরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) নোটিস ধরিয়ে দেবে। আমরা মানব না!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা চাই আদিবাসী, তফসিলি হোক, সবার ভোটার তালিকায় নাম তুলতে হবে। যাঁরা ভাবছেন আপনার ভোটার কার্ড আছে, আর কিছু করতে হবে না। নিয়মটা পাল্টে দিয়েছে। আবার নতুন করে নাম তোলার চক্রান্ত চলছে। ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে কি না, তা আগের তালিকা দেখলে হবে না। নতুন ভাবে গিয়ে মেলাতে হবে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘এখন যদি বলে, ২০০২ সালে ১৮ বছর বয়স হয়েছে। ৪৬ বছর আগে কারা বাবা ও মায়ের জন্মের শংসাপত্র জোগাড় করতে হবে, যাঁরা বলছে তাঁদের আছে তো! তাঁরা সোনার চামচ মুখে জন্মেছেন, তাঁরা কী করে বুঝবেন খেটে খাওয়া মানুষের কথা, গরিব মানুষের কথা!’’ বিজেপির নাম না-করেই মমতার অভিযোগ, ‘‘এটা ডাবল ইঞ্জিন সরকারের চক্রান্ত চলছে। মানুষের নাম বাদ দিয়ে তাঁদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া!’’
দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যালয়ে এ দিন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন, “২০০২ সালে যখন ভোটার তালিকা পরিমার্জন হয়, তখন দু’বছর লেগেছিল গোটা প্রক্রিয়ায়। ঘরে ঘরে গিয়ে করা হয়েছিল। বিহারে কী ভাবে মাত্র দু’মাসে ৬৫ লাখ লোকের নাম বাদ পড়ে গেল? এই ভাবে চলতে থাকলে তো দেশের ১৫ কোটি লোকের নাম বাদ পড়ে যাবে! আগে বলেছি আবারও বলছি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যায্য ভাবে দু’জন মানুষের নাম বাদ দিয়ে দেখাক কমিশন! আমরা বড় মাপের আন্দোলনে নামব।”
ফর্ম পূরণ না-করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানের প্রেক্ষিতে পাল্টা সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। ঘাটালে দলীয় কর্মসূচিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “হ্যাঁ, সবাই ভোটার তালিকায় নাম তুলবে। শুধু বাংলাদেশি মুসলমান আর রোহিঙ্গাদের নাম থাকবে না।” বিরোধী দলনেতার দাবি, ‘‘উনি (মমতা) বাঙালিদের জন্য একেবারে কেঁদে আকুল! কোনও বাংলা-বাঙালির গল্প নয়। বাংলাদেশি মুসলমান ও রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে হবে। ওরা বাদ গেলে দিদি চিৎপটাং!’’ রাজ্যের ডব্লিউবিসিএস আধিকারিকদের উদ্দেশে খোলা চিঠিও দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। সেখানে তিনি আবেদন জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারি আধিকারিকেরা যেন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বিচ্যুত না হন। নির্বাচন কমিশনের করা শাস্তির সুপারিশ মানা হবে না বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সরকারি আধিকারিক নয়, আসলে প্রশাসনের ভিতরে থাকা শাসক দলের উপদেষ্টা সংস্থার লোকজনকে বাঁচাতে চাইছেন, খোলা চিঠিতে এমন দাবিও করেছেন বিরোধী নেতা।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ফর্ম পূরণ করতে বারণ করছেন কেন, জানি না। কিন্তু ভোটার তালিকায় নাম তুলতে গেলে, মৃত মানুষের নাম কাটতে গেলে বা মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় ঢুকে থাকা ‘ভূতেদের’ নাম বাদ দিতে হলে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করতেই হবে। মুখ্যমন্ত্রীই বলেছিলেন ভিন্ রাজ্যের নাম নাকি ঢুকিয়ে রাখা আছে, সেগুলো কাটতে হলেও ফর্ম পূরণ করতে হবে। যেটা বলা উচিত, ভোটার তালিকার জন্য বাপ-ঠাকুরদার কাগজ কমিশন চাইতে পারে না। ওটা ‘ডি-ভোটার’ করার পরিকল্পনার অঙ্গ।’’
সংসদের অধিবেশন বসার আগে গত কয়েক দিনের এ দিনও সকালে মকরদ্বারের সমানে এসআইআর নিয়ে ধর্না-বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিরোধী জোটের সাংসদেরা। এর পরে ‘ভোট চুরি’ নিয়ে আলোচনার দাবিতে লোকসভা এবং রাজ্যসভা দফায় দফায় অচল করেছেন তাঁরা। পরে তৃণমূলের লোকসভার নতুন দলনেতা অভিষেক বলেছেন, “আমাদের দল স্পিকারকে বারবার বলছে, আমরা চাই সংসদ চলুক, এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক। সরকারের যদি ভয় না থাকে, তা হলে কেন আটকানোর চেষ্টা করছে?” এই প্রসঙ্গে বারবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা প্রাক্তন স্পিকার বলরাম জাখরের পুরনো ‘রুলিং’ দেখিয়ে বলছেন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত এবং কাজকর্ম নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যায় না। অভিষেকের বক্তব্য, “কোনও না কোনও ভাবে, দৃষ্টি আকর্ষণ প্রস্তাবে তোলা তো যায়ই। তা ছাড়া, এটা শুধু সংসদের নয়, মাঠে নেমে লড়াইয়েরও বিষয়।” তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের মতে, “কেন্দ্র একটা উদাহরণ দেখাচ্ছে কিন্তু এর উল্টো উদাহরণ বা ‘রুলিং’ও রয়েছে। বিদায়ী রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ধনখড় বলেছিলেন, সমস্ত কিছু নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যায় একমাত্র বিচারকের বিরুদ্ধে অপসারণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ছাড়া।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)