নয়াদিল্লির সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে। ছবি: রাজেশ কুমার
মুখে তিনি বলছেন, তিনি আছেন। দলও তা-ই বলছে। কিন্তু কাজে মালুম হচ্ছে, তিনি আসলে থেকেও নেই!
মুকুল-রহস্য জারি থাকতে থাকতেই এ বার ‘মুকুলহীন’ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল তৃণমূলের অন্দরে। তৃণমূলের সংগঠনের উপরে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দুর্দান্ত প্রভাব হাল্কা করে দিতেই এমন প্রয়াসে হাত দিতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
কোন জেলার কোথায় সংগঠনের কোন স্তরে কে দায়িত্বে আছেন, এ সব তথ্য মুকুলের নখদর্পণে। এত দিন মুকুলের ‘নেটওয়ার্কে’র ভরসাতেই দলকে ছেড়ে রেখেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু এখন মুকুলকে নিয়েই তাঁর মনে গভীর অবিশ্বাস এবং সন্দেহ! মুকুলের গতিবিধিও রহস্যময়! তাই সংগঠনে মুকুলের কাজ নিজের হাতে নিতে চাইছেন মমতা। এ বার প্রয়োজনে তৃণমূল নেত্রী নিজেই যাতে যাতে এক জন ব্লক স্তরের নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন, তার জন্য সফ্টঅয়্যারে তথ্য-ভাণ্ডার গড়া হচ্ছে।
দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এক নিমেষে দলনেত্রী যাতে যে কোনও নেতার সঙ্গে কথা বলতে পারেন, তার ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছে। সফ্টঅয়্যারের মাধ্যমেই সরাসরি নেতাদের খোঁজখবর দলনেত্রীর হাতে থাকছে।
দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক স্বমহিমায় থাকতে থাকতে রাজ্য জুড়ে যে ‘নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছিলেন, রাতারাতি তা হাতের মুঠোয় আনতে হিমশিম খেতে হয়েছে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের! মুকুল এক জন বুথ স্তরের নেতাকেও নামে চিনতেন। কোনও সমস্যা হলে তিনিই সরাসরি সেই নেতার সঙ্গে কথা বলে তা মেটাতেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুকুলের অনেক দায়িত্ব মমতা ভাগ করে দিয়েছেন পার্থবাবু, দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী এবং দলের অন্যতম নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে। সঙ্গে অবশ্যই ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এঁদের কারও কাছেই দলের যে কোনও স্তরের নেতাদের ফোন নম্বর বা হাল-হকিকত মজুত নেই। মমতা এ বার সেই অবস্থারই পরিবর্তন চান।
দিল্লিতে মুকুল অবশ্য মঙ্গলবারও দেখাতে চেয়েছেন, তিনি আগের মতোই আছেন! দিল্লিতে এ দিন ছিল কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটির বৈঠক। আজ, বুধবার তেমন কোনও ‘কাজ’ না থাকলেও দিল্লিতেই থেকে যাচ্ছেন।
সারদা নিয়ে তৃণমূলের দায়ের-করা মামলা সুপ্রিম কোর্টে ওঠার কথা পরশু। মুকুলের যুক্তি, বারবার দিল্লি যাতায়াত করা সমস্যার। তা ছাড়া, এখন বিমানের টিকিট পাওয়ার সঙ্কটও রয়েছে! সাংসদ কোটায় বিমানে যাতায়াতকারী মুকুল টিকিট পাচ্ছেন না বলে দিল্লিতে থেকে যাচ্ছেন, এই যুক্তি তৃণমূলেও ক’জন বিশ্বাস করবেন সন্দেহ! তাঁর সঙ্গে আবার বিক্ষুব্ধ বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। যাতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত! যদিও মুকুলের পাল্টা মন্তব্য, “ও যদি বিক্ষুব্ধ হতো, তা হলে কি আর আমার সঙ্গে ঘুরত?” যা শুনে বিস্মিত দলেরই এক নেতা বলছেন, “বিক্ষুব্ধ বলেই তো মুকুলের সঙ্গে ঘুরছে!”
ঘরোয়া আলাপচারিতায় মুকুল এ দিনও বারবার বোঝাতে চেয়েছেন, কিছুই বদলায়নি! তিনি তৃণমূলের অনুগত সৈনিক। বিজেপি-র দিকে ঝোঁকার কণামাত্র সম্ভাবনাও তাঁর নেই। সাম্প্রতিক অতীতেও করেননি, এ বারও বিজেপি-র কোনও নেতার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কর্মসূচি নেই বলে ফের জানিয়েছেন। বনগাঁর উপনির্বাচনের জন্য আগামী ৭ থেকে ১১ তারিখ আগের মতোই প্রাণপাত করবেন। এরই মধ্যে সারদা-কাণ্ডে দলের রাজ্যসভার সাংসদদের হয়রান করার প্রতিবাদে শুক্রবার উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির কাছে দরবার করতে যাবে তৃণমূলের সংসদীয় প্রতিনিধিদল। সেখানে মুকুল থাকবেন? দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বলছেন, “নিশ্চয়ই! উনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক!”
উপরে উপরে যখন মুকুলকে এমন জড়িয়ে নেওয়ার বার্তা, দলের ভিতরেই তখন অন্য ছবি! দলের এক রাজ্য নেতা বলছেন, “দলে কেউই অপরিহার্য নয়! দলে এক জনই কম্যান্ডার। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।” দলের অন্দরেই কেউ কেউ বলছেন, মুকুলের আমলে জেলা বা ব্লক স্তরে পদাধিকারীকে চিঠি দিয়ে নিয়োগ করার বালাই ছিল না। এখন সেই ব্যবস্থা বদলাচ্ছে। পাশাপাশি মুকুলের দল ভাঙানোর ‘দক্ষতা’কে কটাক্ষ করে দলের এক প্রথম সারির নেতার মন্তব্য, “ব্যাঙডুবির একটা ব্যাঙকে নিয়ে এসে বলা হল, উনি অমুক ব্লকের সিপিএমের নেতা ছিলেন। তাঁকে এনেই একটা পদ দিয়ে দেওয়া হল!” ওই নেতার অভিযোগ, এই ধরনের ‘সুবিধাভোগী’রাই এখন মুকুলের পিছনে রয়েছেন। আসল নেতা-কর্মীরা আছেন মমতার সঙ্গেই।
তৃণমূল ভবনে গিয়ে এ দিনই ‘যুবরাজ’ বসেছিলেন যুব তৃণমূলের সভাপতির জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। একদা ওই ঘরেই বসতেন মুকুল! সেই ঘরে বসে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম, ইন্দ্রনীল সেন, অলক দাসদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন অভিষেক। মুকুলকে নিয়ে দলে সমস্যা তৈরি হয়েছে কি না, প্রশ্ন উঠলে প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে অভিষেক বলেছেন, “ধূর, কোথায় সমস্যা?”
উত্তর ধরা আছে সফ্টঅয়্যারেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy