Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

টাটা গোষ্ঠীর সংস্থার সঙ্গে বৈঠক মমতার

সিঙ্গুর নিয়ে নভেম্বরেই রায় দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। তার আগে এ দিন, সোমবার টাটা গোষ্ঠীর এ রাজ্যে ব্যবসা করা সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে ঘণ্টা দেড়েকের ওই আলাপচারিতায় জানতে চাইলেন, এখানে কাজ করতে তাঁদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। এমনকী সমস্যার কথা উঠলে, জলদি তার সমাধানের জন্য তখনই ফোনে কথা বললেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তাদের সঙ্গে।

সাংবাদিকদের মুখোমুখি অমিত মিত্র। রয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও। সোমবার নবান্নে।  নিজস্ব চিত্র

সাংবাদিকদের মুখোমুখি অমিত মিত্র। রয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও। সোমবার নবান্নে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৫৪
Share: Save:

সিঙ্গুর নিয়ে নভেম্বরেই রায় দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। তার আগে এ দিন, সোমবার টাটা গোষ্ঠীর এ রাজ্যে ব্যবসা করা সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে ঘণ্টা দেড়েকের ওই আলাপচারিতায় জানতে চাইলেন, এখানে কাজ করতে তাঁদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। এমনকী সমস্যার কথা উঠলে, জলদি তার সমাধানের জন্য তখনই ফোনে কথা বললেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তাদের সঙ্গে।

অনেকের মতে, যাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সুবিদিত, সেই টাটা গোষ্ঠীকে আলোচনার জন্য ডেকে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমত, সিঙ্গুর নিয়ে রায়ের আগে টাটাদের দিকে কিছুটা সন্ধির হাত বাড়িয়ে রাখলেন মমতা। আর দ্বিতীয়ত, পা ফেলতে চাইলেন নিজের এবং দলের শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তি মোছার পথে। কিন্তু শিল্পমহলের এক বড় অংশের প্রশ্ন, শুধু টাটা-কর্তাদের বৈঠকে ডেকে কি রাজ্যে শিল্পের মুখ থুবড়ে পড়া ছবি বদলাতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী? তাঁদের মতে, এতে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধি হবে কি না, তার উত্তর দেবে সময়ই। কিন্তু জমি-নীতি বদল বা তোলাবাজি রোখার মতো গোড়ার বিষয়গুলি ঠিক না করলে, এতে শিল্পায়নের চিঁড়ে যে ভিজবে না, সে বিষয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত তাঁরা।

সিঙ্গুর-জট কাটাতে সম্প্রতি টাটাদের আদালতের বাইরে আলোচনার জন্য পরোক্ষে আহ্বান জানিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পুর এবং নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও দাবি করেছিলেন, তাঁরা টাটাদের ন্যানো প্রকল্পের বিরোধী নন। শুধু সিঙ্গুরে জমি নেওয়ার পদ্ধতির প্রশ্নেই তৎকালীন রাজ্য সরকারের ভূমিকার বিরোধী ছিলেন তাঁরা। যদিও কিছু দিন আগে রতন টাটাকে সরাসরি কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তিনি এবং শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। এ দিনও সিঙ্গুর নিয়ে প্রশ্নে খানিকটা অসন্তুষ্টই হন শিল্পমন্ত্রী। মুখে কিছু না বললেও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলুক, তা তিনি চাইছিলেন না। যদিও টাটা-কর্তারা এবং রাজ্য দু’তরফেরই দাবি সিঙ্গুর নিয়ে কোনও কথা এ দিন হয়নি।

অনেকে আবার মনে করছেন, দল হিসেবে তৃণমূলের গায়ে শিল্পবিরোধী তকমা সেঁটে রয়েছে সেই সিঙ্গুর আন্দোলন থেকে। সরকারে আসার পরেও তা বদলায়নি। কিন্তু রাজ্যের মলিন ভাবমূর্তি, লগ্নিতে ভাটা, শিল্পে খরা আর সেই সূত্রে কাজের নতুন সুযোগ তৈরি না হওয়া যে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে তাঁকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাতে পারে, তা বিলক্ষণ বুঝছেন মমতা। বিশেষত সারদা আর খাগড়াগড়-কাণ্ডে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর। আর সেই কারণেই সেই সমস্ত সমালোচনা ঝেড়ে নতুন করে দৌড় শুরু করতে শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইছেন তিনি। চাইছে তাঁর দলও। মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চাইছেন, জমি-নীতি নিয়ে তাঁরা অনড়, শিল্প রুখতে নন। এক শিল্পকর্তার কথায়, সেই ভাবমূর্তি তৈরির প্রথম ইঁট হিসেবেই হয়তো এ দিন টাটাদের ডাকা। কিন্তু শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বদলগুলি না করে, শুধু এ ধরনের বার্তায় কতটা কাজ হবে, তা নিয়ে রীতিমতো সন্দিহান তাঁরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এ রাজ্যে লগ্নি রয়েছে বা সদর দফতর রয়েছে, এমন কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে এ দিন বৈঠকে বসতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার জন্য কেউ শিল্পমন্ত্রীর ফোন পেয়েছেন। কেউ ডাক পেয়েছেন অন্য সংস্থার শীর্ষ কর্তার কাছ থেকে। এ দিন দুপুর তিনটে নাগাদ টাটা-কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন মমতা। সেখানে ছিলেন, টাটা-হিতাচির এমডি রণবীর সিংহ, টাটা মেটালিক্সের এমডি সঞ্জীব পল, টিএম ইন্টারন্যাশনাল লজিস্টিকসের চেয়ারম্যান সন্দীপন চক্রবর্তী ও সংস্থাটির এমডি আর এন মূর্তি, টাটা স্টিল প্রসেসিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের এমডি আব্রাহাম স্টিফানোজ এবং এম জংশনের এমডি বীরেশ ওবেরয়। ছিলেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রও।

পরে সন্দীপনবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, আমাদের কোনও সমস্যা আছে কিনা। বৈঠক খুবই ইতিবাচক।’’ এ রাজ্যে টাটা মেটালিক্স ও টাটা-হিতাচির সম্প্রসারণ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, সে জন্য পরিকাঠামোগত ও ছাড়পত্র সংক্রান্ত কিছু সাহায্য প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের ফোন করে বিষয়গুলি দ্রুত মেটাতে বলেন মমতা। কিছু নির্দেশ দেন শিল্পমন্ত্রীকেও। জানান, রাজ্য সর্বতোভাবে তাঁদের সাহায্য করতে তৈরি। হলদিয়ায় টিএম ইন্টারন্যাশনালের দু’টি ডকে ব্যবসা বৃদ্ধির পরিকল্পনার কথা তোলা হয়। সেই সূত্রে সাগরে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের বিষয়ে টাটা-কর্তাদের ভাবতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী।

এ দিন রুগ্ণ চা-বাগান বিক্রি করতে এম জংশনের সহযোগিতা চেয়েছে রাজ্যও। বীরেশ জানান, সে ক্ষেত্রে কোন পথে এগোলে সরকার সবচেয়ে লাভবান হবে, সেই পরামর্শ চান মুখ্যমন্ত্রী। এ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করবে তাঁর সংস্থা।

সন্দীপনবাবুর দাবি, এ রাজ্যে সংস্থা চালানোর ক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যেকেরই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই কারণেই তাঁরা এগিয়ে এসেছেন। টাটা-হিতাচির শীর্ষ কর্তা রাজ্যে নতুন পরিকল্পনার কথা জানানোর পাশাপাশি দাবি করেন, টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক খারাপ নয়। কোনও সমস্যাও নেই। এ রাজ্যে তাঁরা বেশ ভালই আছেন। টাটা মেটালিক্সের সঞ্জীব পলের আবার দাবি, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রসারণের কথা ভাবছেন। পরিকল্পনা করছেন আরও দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের। তাতে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

শিল্পমন্ত্রীও বলেন, “রাজ্যে টাটাদের সংস্থাগুলিতে প্রায় ৩০ হাজার কর্মী কাজ করছেন। আরও লগ্নি বাড়ানোর কথাও ভাবছে টাটা-সংস্থাগুলি।” তিনি জানান, টাটা গোষ্ঠীর তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টিসিএস ৪০ একর জমিতে নতুন ক্যাম্পাস তৈরির কাজ শুরু করেছে। সেখানে ২০ হাজার জনের কর্মসংস্থান হবে।

কিন্তু সরকারি ভাবে এ সব ঘোষণা সত্ত্বেও অনেকের মতে, এ দিনের বৈঠক আসলে মমতা-সরকারের ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর চেষ্টা। তাঁদের মতে, রাজ্যে শিল্পের দুর্দশার ছবি এখন প্রকট। দেশে-বিদেশে ভাবমূর্তি তলানিতে। সম্মেলন করে নতুন লগ্নি টানা তো দূর অস্ত্, জমি-নীতি ও তোলাবাজির দাপটে সঙ্কটে অনেক চালু শিল্পও। অথচ শিয়রে বিধানসভার ভোট। সেখানে আবার এত দিনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের পাশাপাশি লড়তে হবে নতুন কাঁটা বিজেপির সঙ্গে। শিল্পায়ন ও সেই সূত্রে কাজের নতুন সুযোগ তৈরিকে কেন্দ্রে নিজেদের মুখ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে তারা। ফলে তার আগে শিল্পমহলকে বার্তা দিতেই এ দিন বেছে নেওয়া হয়েছে সেই টাটা গোষ্ঠীকে, যাদের প্রকল্পকে কেন্দ্র করেই সিঙ্গুর-বিতর্কের সূত্রপাত। এবং এখনও রাজ্যে লগ্নি আসার পথে বাধা হিসেবে শুরুতেই আসে ন্যানোর সিঙ্গুর ছাড়ার প্রসঙ্গ। তবে টাটা মোটরসের কেউ এ দিনের বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলেন না। এ রাজ্যে তাদের ব্যবসাও নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE