রাজ্যের মাথায় চেপে থাকা বিপুল দেনার ভার নিয়ে আরও এক বার কেন্দ্রের কাছে দরবার করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে এ বারেও পেলেন আশ্বাস। অতীতে যেমনটি পেতেন মনমোহন সিংহের কাছ থেকে। কিন্তু কাজের কাজ এগোয়নি কিছুই। এখন তাই আর না আঁচালে বিশ্বাস করতে রাজি নন তৃণমূল নেত্রী। দলের সাংসদদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, রাজ্যের স্বার্থের প্রশ্নে সংসদে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। দরকারে প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকেই সরব হতে হবে। নামতে হবে ওয়েলেও।
আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার ডাক দিয়েছিলেন অনেক আগেই। এ বারের দিল্লি সফরে গত কাল গভীর রাত পর্যন্ত তারই জমি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন মমতা। লক্ষ্য, কেন্দ্রীয় সরকারে দেশের প্রধান দুই দল, বিজেপি-কংগ্রেসের দাদাগিরি বন্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মেনে রাজ্যগুলির উপযুক্ত মর্যাদা আদায়। আজ সন্ধেয় অরবিন্দ কেজরীবালের বাড়িতে ঘণ্টাখানেক কাটান মমতা। মোদী তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের রাজনীতি করছেন— আপের এই অভিযোগ প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। গণতন্ত্রে সরকার আসে যায়। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে যেমন সুসম্পর্ক থাকা জরুরি, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সুসম্পর্ক রাখাটাও আমাদের পরম্পরা।’’ পঞ্জাব ভোটে লড়তে নামা আপকে আগাম শুভেচ্ছাও জানান তৃণমূল নেত্রী।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠকে মমতার পাখির চোখ ছিল নিজ রাজ্যের হক আদায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মমতা এ দিন মূলত দু’টি বিষয়ে জোর দেন: • রাজ্যের আর্থিক ঋণের বোঝা। এবং • উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি, তার কারণ ও প্রতিকার। দু’জনের কাছেই পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মোদীর কাছে রাজ্যের ঋণের সার্বিক পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ঋণের পুনর্বিন্যাস হলে সব রাজ্যের সুবিধে হবে। তা না হলে অল্প বা বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হোক। রাজ্যের বাজেট যেখানে ৫৩ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ঋণ মেটাতেই যাচ্ছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।’’ উন্নয়নের স্লোগান তোলা প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে তাই মমতার প্রশ্ন, ‘‘দেনা শুধতেই বেলা যায়। রাজ্যের উন্নয়নটা তবে করব কী করে?’’
মোদীর সঙ্গে বৈঠকটি হয় সংসদে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। বৈঠকের পরে বাইরে এসে মমতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মমতা সাংসদদের বলে দিয়েছেন, দাবিদাওয়া না মেটা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। দলের লোকসভা নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ। তাই লোকসভায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুগত বসুকে তিনি আক্রমণের পুরোভাগে থাকতে বলেছেন। সুগত বসুর কথায়, ‘‘কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আমাদের মতোই অন্য অ-বিজেপি রাজ্যগুলি বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এই বন্ধনীর ভিতরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে নেত্রী সরব হতে নির্দেশ দিয়েছেন।’’
এ দিন দুপুরে জেটলির কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে যান মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা হয়। এর পর দু’জনেই চলে আসেন সংসদে। জেটলির সঙ্গে ঠিক কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা বিস্তারিত জানাননি মমতা। তবে বলেছেন, ‘‘রাজ্যের সমস্যাগুলি সম্পর্কে জেটলি অবহিত। যত ক্ষণ না
কেন্দ্রের ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি তত ক্ষণ এ বিষয়ে কিছু বলব না। রাজ্যের হয়ে বারবার মুখ খোলাটা আমার কাজ। তাই বারবার সব ছেড়ে চলে আসি।’’
এর পর সাড়ে তিনটেয় মোদীর সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে সংসদের দলীয় দফতরে মুকুল রায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সীদের সঙ্গে এক দফা আলোচনা সেরে নেন নেত্রী। তাঁর নির্দেশ আধার কার্ড নিয়ে আন্দোলন চালু রাখতে হবে। কারণ, রাজ্যের একটি বড় অংশের মানুষের কাছে ওই কার্ড পৌঁছয়নি। গরিবরা সরকারি সুবিধার নগদ হস্তান্তরের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ নিয়ে সুর চড়াতে রাজ্যসভায় আগামিকাল আলোচনা চেয়ে তাই নোটিস দিয়েছে তৃণমূল। নেত্রীর নির্দেশে রাজ্যসভায় আজ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরব হন
ডেরেক ও’ব্রায়েনরা।
কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অনুদান কমিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধেও বৈঠকে সরব হন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘৩৯টি প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ ও ৫৮টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান বিপুল ভাবে কমে গিয়েছে।’’ রাজ্যের অভিযোগ, সর্বশিক্ষা খাতে অনুদান কমে যাওয়ায় মিড ডে মিল দিতে সমস্যা হচ্ছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে সর্বশিক্ষা অভিযানের আওতায় থাকা প্রায় পাঁচ লক্ষ শিক্ষক-কর্মীর বেতন দেওয়া নিয়েও। কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের হার কমানোয় রাজ্যের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, কেন্দ্র তা মেটাবে বলেছিল। কিন্তু এই খাতে এখনও ৬৫০০ কোটি টাকা পায়নি রাজ্য। অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহহিল খাতেও কেন্দ্রের পক্ষ থেকে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা রাজ্য পায়নি বলে সরব হন মমতা।
উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক আকার নিতে শুরু করেছে, সেই বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীকে জানান তিনি। মমতার অভিযোগ, গত বারের প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা খাতে ৮০০০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছে কেন্দ্র। বাকি টাকা আসার আগেই ফের বন্যা এসে হাজির। অবিলম্বে এই খাতে বকেয়া অর্থ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদ্বির করেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy