প্রশ্ন যা-ই হোক না কেন, সুর সপ্তমেই।
তৃণমূল কংগ্রেসের সব চেয়ে বড় বাৎসরিক কর্মসূচির আগে ধর্মতলার সভা-মঞ্চে এসে সেই বার্তা দিয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গণতন্ত্র নিয়ে বিজেপি ও সিপিএমকে আক্রমণের পাশাপাশি ঘুরিয়ে ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের তোলা প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন তিনি। মমতার বক্তব্য, ‘‘এই সমাবেশ শহিদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আর গণতন্ত্র রক্ষা দিবস। এই কর্মসূচি চির কাল চলবে!’’
কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ধর্মতলার এই সমাবেশে বরাবরই তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন করেছে। রাজ্যে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে এ বারের আয়োজনও যে তার ব্যতিক্রম নয়, প্রস্তুতি-পর্ব থেকেই তা স্পষ্ট। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে দলের নেতা-কর্মীরা শনিবার থেকেই কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন। পাশাপাশি, প্রত্যেক বছরের মতো সমাবেশের আগের দিন সভাস্থলের প্রস্তুতি দেখতে এসেছিলেন তৃণমূল নেত্রীও। সেখানেই রবিবার তিনি বলেছেন, ‘‘লড়াই করেছিল আমাদের সহকর্মীরা। তাই এ দিনটি আমরা শহিদ দিবস হিসেবে উদযাপন করি।’’ সেই সূত্রেই বিরোধী সিপিএম ও বিজেপিকে বিঁধেছেন তিনি।
বাম জমানায় ১৯৯৩ সালে তৎকালীন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে ‘নো আইডেন্টিটি কার্ড, নো ভোট’ স্লোগান দিয়ে মহাকরণ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মমতা। পরে তৃণমূল দল তৈরি করে এই কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরাই। সেই প্রসঙ্গে টেনে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘বিজেপি-শাসিত ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যে তো মানুষকে ভোট দিতে দেয় না। আর সিপিএম কী করেছে, আমরা হাতে-নাতে তার ফল পেয়েছি!’’ সিপিএম জমানায় ভোটের দিন বহুতলের ফটকে তালা দিয়ে বাসিন্দাদের আটকে রাখা-সহ কিছু অভিযোগ ফের তুলে তাঁর মন্তব্য, ‘‘তাদের আবার বড় বড় কথা!’’
তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের থাকার জন্য বেশ কয়েকটি অস্থায়ী শিবির এ দিন ঘুরে দেখেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কোচবিহারের যে উত্তম ব্রজবাসীকে অসম সরকার নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিস দিয়েছিল, তাঁকে এ বারের মঞ্চে হাজির করছে তৃণমূল। তিনি ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন শহরে। সেই সঙ্গে যে সব পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে বাংলায় কথা বলার কারণে হেনস্থার মুখে পড়েছেন, তাঁদেরও কয়েক জনের থাকার কথা আজ।
বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্থার প্রসঙ্গ টেনেই এ দিন তৃণমূলের তরফে বলা হয়েছে, ‘বাংলায় পরপর নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে বিজেপি বাংলার মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়ার পথ নিয়েছে। প্রথমে তারা রাজ্যের নায্য পাওনা আটকে রেখেছে। তার পরে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষের উপরে সরকারি মদতে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে’। তৃণমূলের হুঁশিয়ারি, ‘আক্রমণের মুখে বাংলা সব সময়েই রুখে দাঁড়ায়। বাংলার মেজাজকে দমিয়ে রাখা যায় না। এখনও নয়, কখনও নয়’!
তৃণমূলের ‘শহিদ দিবসে’র কর্মসূচি নিয়ে একটি মামলার সূত্রে কলকাতা হাই কোর্ট বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশ দিয়েছে। সমাবেশের কারণে কাজের দিন রাস্তায় যানজট নিয়েও আদালতের নির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কলকাতা পুলিশ সেই আদেশের প্রেক্ষিতে সক্রিয় হলেও মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূলের কর্মসূচি নিয়ে ওঠা প্রশ্ন অবান্তর। আদালতের কথা উল্লেখ না-করলেও রাজনৈতিক বিরোধীদের বিঁধে তিনি বলেছেন, ‘‘এ নিয়েও অনেকের আপত্তি আছে। তারা যখন নবান্ন অভিযান করে, পুলিশের অনুমতি ছাড়া, তখন আপত্তি কোথায় থাকে?’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘আমাদের দেখে ওদেরও কর্মসূচি করতে হয়। কই আমরা তো ওদের দেখে করি না!’’
মমতার ২১শের সমাবেশের দিনই শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যা অভিযানের ডাক দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সংসদের অধিবেশন শুরু হয়ে যাওয়ায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার অবশ্য সেই কর্মসূচিতে থাকছেন না। আর দিলীপ ঘোষের সভা রয়েছে খড়গপুরে। দিল্লি রওনা হওয়ার আগে এ দিন কলকাতা বিমানবন্দরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক অবশ্য বলেছেন, ‘‘এখন ২১শে জুলাই রাজনৈতিক রূপচর্চার মঞ্চ হয়ে গিয়েছে! ২১শে জুলাইয়ের প্রাসঙ্গিকতা সে দিন হারিয়ে গিয়েছে, যে দিন গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া আমলাকে প্রথমে বিধায়ক, মন্ত্রী, পরে রাজ্যসভার সাংসদ করে দিলেন। শহিদদের নাম ব্যবহার করে তৃণমূল তাদের উত্তরণের সোপানে চড়েছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আর আমরা তৃণমূলের কর্মসূচি নিয়ে কেনই বা কথা বলব! ওই দিন আমাদের তো বড় কর্মসূচি আছে।’’
তৃণমূল নেত্রীর তোপের জবাবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘মহাশূন্যে থাকা দলকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মহা দুশ্চিন্তা দেখা যাচ্ছে! বাম জমানায় পঞ্চায়েত, পুরসভা বিরোধীদের হাতে কত ছিল আর এখন ভোটে বিরোধীরা কত পায়, সেটা পাশাপাশি রাখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। বেশির ভাগই অসত্য কথা বলেন, এখন বলেছেন ২১শে জুলাই পুলিশের গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন দেড়শো জন। তা হলে সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হল না কেন?’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)