Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

লিভারের অংশ দিলে মানুষ মরে না, বোঝান ডাক্তারবাবুরা

সে সংসার অবশ্য নামেই। ২০০১ সালে বড় ছেলে অনিমেষের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের আসল সংসার হাসপাতালেই। কখনও তা বহরমপুর সদর হাসপাতাল, কখনও বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল। তবে স্থায়ী ঠিকানা এসএসকেএম হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো বিভাগ।

হাসপাতালে স্ত্রী ও ছোট ছেলে অনিরুদ্ধের সঙ্গে ভূদেব (বাঁ দিকে)। বড় ছেলে অনিমেষ (ডানদিকে)। নিজস্ব চিত্র

হাসপাতালে স্ত্রী ও ছোট ছেলে অনিরুদ্ধের সঙ্গে ভূদেব (বাঁ দিকে)। বড় ছেলে অনিমেষ (ডানদিকে)। নিজস্ব চিত্র

ভূদেব বাগদি (লিভার প্রতিস্থাপন হওয়া অনিমেষ ও অনিরুদ্ধের বাবা)
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:২৫
Share: Save:

আমার বিয়ে হয়েছিল ২০০০ সালে। তখন বয়স ২৪-২৫। মুর্শিদাবাদ জেলার বিছুর আমার গ্রাম। এলাকায় রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে সংসার চালাই। দিনে রোজগার আড়াইশো টাকা। মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার নীচে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার।

সে সংসার অবশ্য নামেই। ২০০১ সালে বড় ছেলে অনিমেষের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের আসল সংসার হাসপাতালেই। কখনও তা বহরমপুর সদর হাসপাতাল, কখনও বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল। তবে স্থায়ী ঠিকানা এসএসকেএম হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো বিভাগ। বড় ছেলের জন্মের ২১ দিনের মাথায় ডাক্তারবাবুদের নজরে পড়ে ওর চোখ হলুদ। দু’-তিন মাস পরে জানলাম, ওর জন্ডিস। বয়স যত বাড়ে, বাড়তে থাকে সমস্যা। চোখ আর প্রস্রাব হলুদ হত, পেট ফুলত, সেই সঙ্গে সারা দিনরাত গা-হাত-পা চুলকে যেত ছেলেটা।

২০০৩-০৪ সাল নাগাদ ছোট ছেলে জন্মায়। ওর বয়স তিন পেরোতেই দেখলাম, দাদার মতো অনিরুদ্ধেরও হুবহু এক লক্ষণ। দুই ছেলেকে নিয়ে এসএসকেএমে এসেছিলাম ১০ বছর আগে। তার আগে লোকের মুখে শুনে চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীকে দেখাতে এসে না পেয়ে ফিরে যাই গ্রামে। ছেলে দু’টোর জন্য মনটা হুহু করত। সম্বল পাঁচ কাঠা জমি ১৭ হাজার টাকায় বেচে দুই ছেলেকে নিয়ে এক দালালের সঙ্গে বেঙ্গালুরু গেলাম। ডাক্তারবাবুরা জানালেন, অন্যের সুস্থ লিভারের অংশ না পেলে বাঁচানো যাবে না ওদের। লিভার যে বদলানো যায়, সে দিনই প্রথম শুনলাম। এক এক জনের খরচ পড়বে ৩৫ লক্ষ টাকা! বুঝলাম, চোখের সামনে দুই ছেলেকে মরতে দেখা ছাড়া উপায় নেই। তখন এক ডাক্তারবাবু বললেন, “তোমার রাজ্যের এসএসকেএমে এই চিকিৎসা অনেক কমে হবে।”

ফিরে এসএসকেএমে চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীকে দেখালাম। দুই ছেলেকে দেখে ডাক্তারবাবুরা জানালেন, দুজনেরই সিরোসিস অব লিভার। তাই লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি। তবে অনিমেষের দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। খরচ সাত লক্ষ টাকার বেশি। অসম্ভব বুঝে ফিরে গেলাম। দুঃখ ভুলতে রাতে মদ খেতাম। ঘোরের মধ্যেই রাত সাড়ে ৩টে পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী পালা করে চুলকে দিতাম দুই ছেলেকে। পরদিন সকালে উঠে জোগাড়ের কাজে বেরিয়ে পড়তাম। এ ভাবেই চলছিল। এক দিন এসএসকেএম থেকে ফোন করে ডাক্তারবাবু জানতে চাইলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ ছেলেকে লিভারের অংশ দিতে চাই কি না। পরিবার নিয়ে কলকাতায় পৌঁছলাম। সব পরীক্ষার পরে স্থির হল, স্ত্রী লিভারের অংশ দেবে বড় ছেলেকে।

অস্ত্রোপচারের তারিখ নিয়ে গ্রামে ফিরতেই বাধার মুখে পড়লাম। তত দিনে গ্রাম প্রধান আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে বুঝিয়েছে, ‘লিভারে ছুরি ঠেকানো মানেই মৃত্যু। ওদের ছেলে মরুক গে। তোমার সুস্থ মেয়েকে কেন মেরে ফেলবে?’ ফোনে সব জানালাম ডাক্তারবাবুকে। বললেন, ‘‘তোর বাড়িতে ওঁদের সবাইকে এক দিন ডাক। স্কুলমাস্টারও যেন থাকেন। আমি যাচ্ছি।’’ মাটির ঘরে মিটিং বসল। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে এলেন বাবার লিভারের অংশ পেয়ে সুস্থ রোশন আলির বাবা, রজব আলি। দিনের শেষে শ্বশুর বাদে সকলে বুঝলেন। অস্ত্রোপচার করে সুস্থ হল বড় ছেলে। সালটা ২০১১।

ছেলের যাতে সংক্রমণ না হয়, তাই পাকা ঘর করতে ডাক্তারবাবুরাই দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন।

পরের লড়াইটা শুরু হল ছোট ছেলেকে নিয়ে। বেশ কয়েক বছর হাসপাতালে চক্কর কাটার পরে ২০১৮ সালের মে মাসে জানা গেল, আমার আর ছোট ছেলের লিভার ম্যাচ করছে। অপেক্ষা করছিলাম, কবে ওকে সুস্থ দেখব। গত সাত মাসে বার তিনেক আমার লিভারের ছবি নিয়ে এসএসকেএমের ডাক্তারবাবুরা দিল্লি-চেন্নাই ঘুরে এ বছরের জানুয়ারিতে জানালেন, ওই লিভার পেলে ছেলেটা মরে যাবে। ভাবলাম, তার আগে নিজেকেই শেষ করে দেব। মাকে নিয়ে এলাম। লিভার ম্যাচ করল না। শাশুড়িকে নিয়ে এলাম, পরীক্ষায় মিলে গেল। তারিখ ঠিক করে ফিরে গেলাম। ফের বাধা। এ বার দুই শ্যালিকা ও ভায়রাভাই রুখে দাঁড়ালেন। বেঁকে বসলেন শাশুড়িও। বাড়ি ফাঁকা হতেই খুড়তুতো শ্বশুর-শাশুড়ির সাহায্যে অনেক বুঝিয়ে শাশুড়িকে রাজি করালাম। অস্ত্রোপচারের পরে দু’জনেই হাসপাতালে ভর্তি। লম্বা লড়াইয়ে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি, মেমারি এবং কীর্ণাহারের দুই মাস্টারমশাইকে। যাঁরা টাকা আর বুদ্ধি দিয়ে আমাদের সাহস জুগিয়েছেন।

মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি অনেক দিন। এখন আমরা নিশ্চিন্ত। আরও রোজগার করব। বাকি জীবন শাশুড়িকে আমিই দেখব। ছেলেটার জীবন ওঁর জন্যই তো বাঁচল। লক্ষ লক্ষ টাকা পে লেও তা হত না। মাঝেমধ্যে মন্দিরে আসব ভগবানের দর্শনে। এসএসকেএম-ই তো আমাদের মন্দির। আর ডাক্তারবাবুরা ভগবান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Liver Transplantation Liver Cirrhosis SSKM Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE