তেভাগা স্মৃতিসৌধের কাছে ফেরিঘাটের সামনে। — নিজস্ব চিত্র।
গলায় কণ্ঠি। উদোম গা। পরনে হেঁটো ধুতি। এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। হাত ধরে এসে বললেন, ‘‘ওদের কথা শুনিনি বলে মেরে পা খোঁড়া করে দিল!’’ কী কথা শোনেননি? ‘‘একশো দিনের কাজের টাকা চাইতে গিয়েছিলাম। দিল তো না-ই। উল্টে মারধর করল।’’ কবে? ‘‘তা সে দু’বছর আগে।’’ ততক্ষণে চোখে জল প্রদীপ মণ্ডলের। ধরে এসেছে গলা।
সন্দেশখালি দ্বীপের ভিতরে যত যাওয়া যায়, এমনই সব ঘটনা পরতে পরতে খুলে আসে। চোখের জলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে রাগও। যে রাগে কিছুটা হলেও রাজনীতির রং ধরে গিয়েছে। কেমন সেই রাগ? যেমন, ৮ নম্বর কর্ণখালিতে দাড়িয়ে এক দফা কান্নাকাটি, ক্ষোভ-বিক্ষোভের পরে ফুঁসছিলেন সেই মেয়েটি। ব্যক্তিগত সমস্যা ছাপিয়ে তখন তিনি বলতে শুরু করেছেন, ‘‘আমরা বরাবর জানি, রাম আমাদের আরাধ্য দেবতা। কিন্তু ত্রিমনি বাজারে গিয়ে আমরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে পারি না। বললে শিবুর (শিবপ্রসাদ হাজরা) লোকজন ধাওয়া দিত।’’ আপনারা দুর্গাপুজো বা সরস্বতী পুজো করতেন? তিনি বলেন, ‘‘সেই সব পুজোই হয়।’’
আপত্তি তবে শুধু কি ‘জয় শ্রীরামে’? এ বারে মেয়েটি চুপ। একটু ভাবলেন। তার পরে বললেন, ‘‘আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছি। আম্বেডকরের কথা জানি। আমাদের তো ‘জয় শ্রীরাম’ বলার অধিকার আছে।’’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সংবিধান আর আইন কি শুধু তিনি একাই জানেন? সন্দেশখালির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, মোটেও তা নয়। পাত্রপাড়াতেই জমায়েত করে ছিলেন যে মহিলারা, তাঁরাও বললেন স্বাধীন নাগরিকের অধিকারের কথা। আবার পুকুরপাড়ায় এসে ফের শোনা গেল প্রশ্ন, ‘‘ওরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে দিত না আমাদের ছেলেদের। কেন?’’
পাত্রপাড়া, বেড়মজুর, কর্ণখালি, পুকুরপাড়া— সব জায়গা থেকেই এই ভাবে বেরিয়ে এসেছে জমা রাগ। কখনও মেয়েদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে, কখনও ছেলেদের মারধরের বিরুদ্ধে, কখনও আবার ভিটেমাটি দখলের বিরুদ্ধে। এই সব রাগে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন তৃণমূলের নেতা ও প্রশাসনের লোকজনেরা। কিন্তু ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে না দেওয়ার রাগ আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা ইঙ্গিত অবশ্যই মাথাব্যথা হতে পারে শাসকদলের।
ধামাখালির খেয়াঘাট দিয়ে সন্দেশখালি যাওয়ার পথে তৃণমূলের পতাকার সঙ্গে গেরুয়া রং পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। আবার এর উল্টো দিকে তেভাগার কাছে নদীর ধার পর্যন্ত বিজেপির পতাকায় ছয়লাপ।
তা হলে কি কোনও রাজনৈতিক দল তলে তলে যোগাযোগ রেখে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? যেমনটা অভিযোগ করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? পাত্রপাড়ায় ক্লাবঘরের সামনে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্নের জবাবে এক মহিলা খুব গুছিয়ে বললেন, ‘‘এমন কিছু নেই। তবে এই ক্লাবঘরের সামনে কয়েক দিন আগে শুভেন্দু অধিকারী এসেছিলেন। আমরা দেখা করে ক্ষোভ জানিয়েছি।’’
এইটুকুই? আর কোনও যোগাযোগ। উনি জবাব এড়িয়ে যাচ্ছিলেন বার বার। কিন্তু রাগ আর ক্ষোভের অভিমুখটা যেন খাল দিয়ে বয়ে যাওয়ার দিশা পেয়ে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছিল। নন্দীগ্রামের যে আন্দোলনের কথা তিনি উল্লেখ করছিলেন, সেখানেও আন্দোলনের পিছনে অন্যতম ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy