বিকাশ। —ফাইল চিত্র।
রাজ্য কমিটির অস্তিত্ব নেই। সে ভাবে রাজ্য সম্পাদক বলেও কেউ নেই। সংগঠন ছত্রখান। এমনকী, গতিবিধি যেটুকু ছিল, সেটুকুও বোধহয় শেষ হতে চলেছে।
প্রথম বার পরিস্থিতিটা ছিল একেবারে উল্টো। তবে মাওবাদী রাজ্যনেতা বিকাশের স্বীকারোক্তি সত্য হলে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর সময়ে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি বা মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ হয়তো তেমন থাকছে না। অন্তত এমনই দাবি গোয়েন্দাদের।
গোয়েন্দারা বলছেন, বিকাশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মাওবাদীদের পুনরুত্থান তো দূরের কথা, তাদের পুনর্গঠিত হওয়ার আশু সম্ভাবনাও খুবই কম বলে মনে হচ্ছে। আবার ঝাড়খণ্ডে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে সম্প্রতি জখম হয়েছেন এই রাজ্যের মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুল। তিন দিন আগে ঝাড়খণ্ডে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক বিশেষ দলের সদস্যরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন।
বিকাশ ওরফে মনসারাম হেমব্রম গত ২ এপ্রিল কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর হাতে ধরা পড়ে। একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তার স্ত্রী তারা ওরফে ঠাকুরমণি হেমব্রমকে । জঙ্গলমহলে ভোট ছিল ৪ এপ্রিল।
গোয়েন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী বিকাশ জেরায় জানিয়েছে, এই রাজ্যে মাওবাদী সংগঠনের আপাতত কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তবে সে মাওবাদী আদর্শ ও নীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি, দল বা নেতৃত্বের প্রতি আস্থাও এতটুকু টলেনি। অথচ পুলিশের কাছে খবর— লালগড় আন্দোলন পর্বে মাওবাদীদের রাজ্য কমিটির সদস্য হওয়া ও রাজ্য মিলিটারি কমিশনের প্রধান বিকাশ ২০১১-র নভেম্বরে কিষেণজি নিহত হওয়ার কিছু দিন আগেই সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা সরে আসে। এর কারণটা কী?
জেরায় বিকাশ জানিয়েছে, তাকে সরে আসতে হয়েছে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতার কারণেই। ২০১১-তে ওই মাওবাদী নেতার শিরদাঁড়ায় সমস্যা দেখা দেয়। অস্ত্রোপচারও করাতে হয়। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ওই অস্ত্রোপচার হয়েছিল বাঁকুড়ার তালড্যাংরার একটি নার্সিংহোমে। বিকাশের কাছ থেকে তার চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি পেয়ে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েছেন তদন্তকারীরা।
কিন্তু শুধু সস্ত্রীক বিকাশ রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার জন্যই কি গোয়েন্দারা এই রাজ্যে মাওবাদী পুনরুত্থানের সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিচ্ছেন?
রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ বা আইবি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘কিছু খবর আমাদের কাছেও ছিল। বিকাশকে জেরা করে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। তাই আমাদের মনে হচ্ছে, মাওবাদীদের এখনই ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও সম্ভাবনা নেই।’’
আইবি সূত্রের খবর, বিকাশ জানিয়েছে, মাওবাদীদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি বলে কিছু এখন নেই।
সেই জন্যই গত চার-পাঁচ বছর ধরে রাজ্য কমিটির মিটিং-ও হয়নি। বিকাশের বক্তব্য অনুযায়ী, কেবল আকাশ ওরফে অসীম মণ্ডল সাংগঠনিক ভাবে কিছু করার চেষ্টা করছে। তা-ও সে আনুষ্ঠানিক রাজ্য সম্পাদক নয়। ওই পদে কেউ নেই এখন। হাজার দশেক টাকা পাঠিয়ে বিকাশকে রাজনীতিতে ফিরে আসতে অনুরোধও করেছিল আকাশ। তবে বিকাশ রাজি হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটেই গোয়েন্দারা মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ইনিংসে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি তাঁকে গোড়া থেকেই স্বস্তি দিতে পারে।
পাঁচ বছর আগে মমতা যখন প্রথম বার ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন জঙ্গলমহলের আতঙ্কিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোটা তাঁর কাছে ছিল চ্যালেঞ্জ। গত পাঁচ বছরে তাঁর শাসনকালের প্রথম ছ’-সাত মাস বাদ দিলে জঙ্গলমহল হিংসামুক্ত। আর এ বার বিধানসভা ভোটে জঙ্গলমহলে একচ্ছত্র আধিপত্যও প্রতিষ্ঠিত শাসক দলের। শান্তি ফেরানো ও নির্বাচনী সাফল্যের কারণ হিসেবে ২ টাকা কেজি দরে চাল বিলি, রাস্তাঘাট-স্কুল-কলেজ-সেতু তৈরি, পুলিশে চাকরির কথা স্বীকার করে নেন বিরোধীরাও। সেই সঙ্গে গত পাঁচ বছরে বহু মাওবাদী নেতা-নেত্রী ধরা পড়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছেন। আবার মাওবাদীদের একটা বড় অংশ যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।
তবে কোনও কোনও তল্লাটে পঞ্চায়েতে দুর্নীতির প্রতিকার না-করলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে বলে গোয়েন্দা-কর্তাদের অনেকের আশঙ্কা। তাঁদের বক্তব্য, ইন্দিরা আবাস পেতে গেলে কোনও কোনও গ্রামে শাসক দলের নেতাদের কমিশন দিতে হয়। একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রেও তাই। একদা মাওবাদীরা কিন্তু অভাব, দুর্নীতি ও অসন্তোষ জনিত রন্ধ্রপথ দিয়েই ঢুকে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, ‘‘জঙ্গলমহল ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের বহু এলাকায় মাওবাদীরা কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এই রাজ্যের মাওবাদীরাও তাতে থাকছে। তাই, নতুন সরকার এসেও যৌথ বাহিনী তুলতে চাইবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy