Advertisement
E-Paper

বইমেলা দেখতে এসেছি, মাটিতীর্থে বললেন ‘চাষি’

ওঁরা সকলেই বিনি পয়সায় বাসে চেপে এসেছিলেন চাষ শিখতে। হুগলির সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, রাজারহাটের বাস-মালিক, হাওড়ার আইএনটিটিইউসি নেতা। চাষবাসের একশো মাইলের মধ্যে যাঁরা যান না। আবার মুকুন্দপুর বা চন্দ্রকোনা থেকে আসা সেই সত্যিকারের চাষিরাও ছিলেন, জোরাজুরি করে যাঁদের বোরো চাষের জমি থেকে তুলে আনা হয়েছে। খেতে হাজির থাকাটাই যখন সবচেয়ে জরুরি, তাঁদের আসতে হয়েছে এমন এক সভায় যার সঙ্গে চাষের কলাকৌশল বা প্রশিক্ষণের সত্যি কোনও সম্পর্ক নেই।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০

ওঁরা সকলেই বিনি পয়সায় বাসে চেপে এসেছিলেন চাষ শিখতে।

হুগলির সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, রাজারহাটের বাস-মালিক, হাওড়ার আইএনটিটিইউসি নেতা। চাষবাসের একশো মাইলের মধ্যে যাঁরা যান না।

আবার মুকুন্দপুর বা চন্দ্রকোনা থেকে আসা সেই সত্যিকারের চাষিরাও ছিলেন, জোরাজুরি করে যাঁদের বোরো চাষের জমি থেকে তুলে আনা হয়েছে। খেতে হাজির থাকাটাই যখন সবচেয়ে জরুরি, তাঁদের আসতে হয়েছে এমন এক সভায় যার সঙ্গে চাষের কলাকৌশল বা প্রশিক্ষণের সত্যি কোনও সম্পর্ক নেই।

বর্ধমান জেলা পুলিশের হিসেবে, সাড়ে ছ’শো-সাতশো বাস, ৬০-৬৫ হাজার লোক। সোমবার বর্ধমানের ঝিঙ্গুটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাটিতীর্থ কৃষিকথা’ অনুষ্ঠানে যাঁদের জুটিয়ে আনতে বর্ধমান-সহ দক্ষিণবঙ্গের ১২টি জেলার প্রশাসনিক অফিসারদের কালঘাম ছুটে গিয়েছে। নিজেরা লোক জোগাড় করতে না পেরে তৃণমূল নেতাদের দোর ধরতে হয়েছে। কোথাও তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতি, কোথাও ব্লক নেতা নিজের উদ্যোগেই লোক ধরে এনেছেন। তৃণমূলের পতাকা লাগানো বেশ কিছু গাড়ি ছোটাছুটি করে বেরিয়েছে সকাল থেকেই।

কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি প্রশিক্ষণ প্রকল্পের (এটিএমএ) টাকায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের ঘোষিত উদ্দেশ্য, কৃষিপ্রযুক্তি ও প্রকরণ বিষয়ে চাষিদের সচেতন করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া। যাঁরা এই সভায় আসেন, উপভোক্তা চাষি হিসেবে তাঁদের নাম সরকারের খাতায় ওঠে। সভায় আসার খরচ, দিনের খোরাকি দেওয়া হয়। পরে চাষ এবং প্রাণিপালন সংক্রান্ত নানা সুযোগ বা প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের নাম বিবেচিত হতে পারে।

কিন্তু কাঁরা এলেন সেই সভায়?

বেড়াতে এসেছি

উৎসবের মাঠে হাল্কা মেজাজে ঘুরছিলেন বছর চব্বিশের কৌশিক সামন্ত। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বাড়ি হুগলির আরামবাগে ডঙ্গল গ্রামে। জানালেন, রাজারহাটে একটি সংস্থায় চাকরি করতেন। সেটি ছেড়ে নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে ছুটিতে রয়েছেন। নিজেই বললেন, “চাষবাসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। আসতে বলেছে, তাই মেলা দেখতে এসেছি।”

বর্ধমানেরই গলসি থেকে এসেছিলেন দুই বৃদ্ধা শান্তি বিশ্বাস ও সুনীতা বারুই। দুই বোন। শান্তিদেবী বলেন, “আমি তো আর চাষ করি না। মমতাকে দেখতে এলাম।” পুরুলিয়ার বলরামপুর থেকে আসা দশরথ মাহাতো জানিয়ে দেন, “সারদা-কাণ্ডে জেরবার হওয়া দিদিকে দেখতে এলাম।” বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাঁটির বর্ণালি ঘোষ আবার অপ্রস্তুত, “তৃণমূলের লোকেরা আসতে বলেছে, কিন্তু কেন এসেছি বলতে পারব না।” বারাসতের কলোনি মোড়ের অচিন্ত্য ঘোষ নিচু গলায় বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। কিছু সুযোগ-সুবিধা পাই, না এলে তো...।”

উত্তর ২৪ পরগনার রাজারহাট থেকে এসেছিলেন দু’টি বাসের মালিক ফারুক মোল্লা। হাসিমুখে তিনি জানান, কৃষিমেলায় বেড়াতে এসেছেন। মেলা দেখতেই বীরভূমের কীর্ণাহার থেকে এসেছিলেন অভিজিৎ বিশ্বাস, হাওড়ার বালি জগাছা থেকে সপরিবার সন্তোষী মাইতি, পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি বিক্রমগড় থেকে সুধাংশু জানা। কী মেলা, তা সুধাংশুবাবু বলতে পারেননি। তবে হাওড়ার পাঁচলা থেকে আসা শুক্লা মাখাল পরম নিশ্চিন্তে বলে দেন, “বইমেলা দেখতে এসেছি।”

দলের সভায় এসেছি

তৃণমূল সংস্কৃতিতে এ জিনিস নতুন নয়। যাদবপুরে ছাত্র আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে শঙ্কুদেব পণ্ডা যে পাল্টা ব্যবস্থা করেছিলেন, তাতেও অনেকেই জানতেন না কেন এই মিছিল। কিন্তু সেই মিছিলের মতো এ দিন ঝিঙ্গুটির মাঠেও এমন বহু মুখ ছিলেন যাঁদের অনুষ্ঠানে আসার কারণ নিয়ে ধন্দ নেই। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা ব্যবহারের জন্য যতই এই অনুষ্ঠানকে প্রশাসনিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা হোক বা নেত্রী নিজে দলের নেতাদের সরাসরি লোক জড়ো করতে নির্দেশ না দিন, অনেকেই সোজাসুজি কারণটি জানিয়ে দিয়েছেন।

নবদ্বীপের অনিল বর্মণ যেমন রাখঢাক না করেই বলেছেন, “শুনলাম তৃণমূলের সভা। তাই এলাম।” নদিয়ারই সন্তোষ সরকার বা বাগনান থেকে শচীন্দ্রনাথ মেটে এসেছেন ‘মা-মাটি-মানুষের উৎসবে’। তমলুকের পুষ্পেন্দু সামন্ত বা ডোমজুড়ের অরুণ খাঁড়া ছোট্ট কথায় সেরেছেন “দলের সভায় এসেছি।” আইএনটিটিইউসি-র হাওড়া জেলা সভাপতি অরূপেশ ভট্টাচার্যকেও দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের গোপালপুর অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি কার্তিক প্রামাণিক পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, “রাজনৈতিক লোক ছাড়া এত বড় সভা ভরাবে কে?”

অনিচ্ছুক চাষি

এই হট্টমেলায় চাষিরা আদৌ ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু অনেকেই বাস থেকে নেমেছেন মুখ ব্যাজার করে, এক রাশ বিরক্তি নিয়ে শুনেছেন বক্তৃতা, আবার ফিরতি বাসে উঠেছেন ব্যাজার মুখে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের স্টল দিলেও তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতা করতে ওঠার আগেই দূরের লোকজন চলেও যেতে শুরু করেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার মটরদিঘি থেকে এসেছিলেন মনিরুল মোল্লা। তাঁর কথায়, “বোরো চাষ চলছে বলে অনেকেই আসতে চাননি। তৃণমূলের নেতারা বলেছেন বলে এসেছি। কিন্তু মন পড়ে রয়েছে চাষের দিকে।” তাঁর জেলারই বিষ্ণুপুর ২ ব্লকের মুকুন্দপুরের স্বপন বিশ্বাস বলে দেন, “আমরা তৃণমূল করি বলে এসেছি। তবে বোরো চাষ চলায় বহু চাষিই আসতে বিরক্ত হয়েছেন।” মেদিনীপুরের সাম্পু-কলাপাই গ্রামের সুনীল মণ্ডল, চন্দ্রকোনার অপু সাঁতরাদের আক্ষেপ, “অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু প্রশিক্ষণের কোনও ব্যাপারই দেখলাম না।”

যে জন আছে মাঝখানে

এই ‘অনিচ্ছুক চাষি’ ও শাসকদলের মাঝে রয়েছেন সেই সব অফিসারেরা, যাঁরা মাঠ ভরানোর সরকারি নির্দেশ না পেরেছেন গিলতে, না পেরেছেন ওগরাতে। অনেককেই এ দিন শুকনো মুখে ছোটাছুটি করতে দেখা গিয়েছে। লোক আনার প্রশ্নে যাঁরা তিরিক্ষে হয়ে বলেছেন, “কোথায় লোক পাব! শাসকদলের লোকদেরই লোক জোগাড় করতে বলা হয়েছিল। কোথা থেকে কাদের আনছে তারা, কী করে জানব!”

পাঁচলা থেকে ‘বইমেলা’ দেখতে লোকে বর্ধমানে চলে গেল কী করে?

তৃণমূল শাসিত পাঁচলা পঞ্চায়েত সমিতির আব্দুল জলিল বলেন, “চাষি নির্বাচনের দায়িত্ব প্রশাসন আমাদেরই দিয়েছিল। ঠিক লোকেদেরই পাঠিয়েছি। ওখানে গিয়ে কে কী বলেছে জানি না।”

পাঁচলার বিডিও মল্লিকা সেনগুপ্ত ফোন ধরেননি। ধরলেও আর কী-ই বা তিনি বলতে পারতেন?

mati tirtha mati festival mamata bandyopadhyay soumen dutta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy