Advertisement
১৯ মে ২০২৪

‘অন্যায় মেনে নেওয়ার সহ্য ক্ষমতা আমাদের নেই’

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নতুন হস্টেলে প্রথম বর্ষের সঙ্গে অন্য বর্ষের ছাত্রদেরও থাকার দাবিতে অনশন করেছিলেন পড়ুয়ারা। সেই অভিজ্ঞতা লিখছেন আন্দোলনকারী দেবাশিস বর্মনআমরা মেডিক্যাল কলেজের মেন হস্টেলেই থাকি। দীর্ঘ দিনের পুরনো ওই হস্টেল বিল্ডিংয়ের প্রায় ভগ্নপ্রায় অবস্থা।

অনশনে: তখন মেডিক্যাল কলেজে আন্দোলন চলছে। নিজস্ব চিত্র

অনশনে: তখন মেডিক্যাল কলেজে আন্দোলন চলছে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৮ ০৩:০০
Share: Save:

গ্রাম থেকে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে আছি। কলকাতা মহানগরে। গ্রাম যেমন আমাকে টানে, তেমনই এই মহানগরের প্রতিও একটা টান তৈরি হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ-হস্টেল-আমার বন্ধুরা, আমার সিনিয়র-জুনিয়র সবাই আমার খুব প্রিয়। আমরা মেডিক্যাল কলেজের মেন হস্টেলেই থাকি। দীর্ঘ দিনের পুরনো ওই হস্টেল বিল্ডিংয়ের প্রায় ভগ্নপ্রায় অবস্থা। অনেক ঘরই আর থাকার উপযুক্ত নয়। ওই হস্টেল বিল্ডিং তিন তলার ছিল। বছর চারেক আগে ছাত্রছাত্রীদের চাপে নতুন করে অস্থায়ী ভাবে চতুর্থ তল তৈরি করা হয়। দুই বছর ব্যবহারের পর ওই ফ্লোর বাতিল করা হবে বলে জানিয়ে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। আসলে অস্থায়ী একটা ব্যবস্থা। তেমন ভাবেই তৈরি করা হয় ওই তলের পরিকাঠামো। দুই বছর পরে সবাইকে নতুন হস্টেল বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়।

এমন চলতে চলতে দুই বছরের জায়গায় চার বছর হয়ে যায় ওই চতুর্থ তলেই ছাত্রদের রাখা হতে থাকে। ছাদের অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে যায়। প্রতিদিন কোনও না কোনও অংশ খসে পড়তে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ি আমরা প্রত্যেকেই। যে কোনও দিন একটা বড় ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়। এমন সময় এই বছরই নতুন হস্টেল বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়। পূর্ত দফতর তা হস্তান্তরিত করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে। এগারো তলের ওই বিল্ডিং দেখে সমস্যা সমাধানের আশায় আমরা সবাই মিলে বুক বাঁধতে থাকি। কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় অবশ্য অন্য চিত্র। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেন, নতুন হস্টেল শুধু প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা নতুন হস্টেলে থাকবে তা নিয়ে আমাদের কারও কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু, কেন বাকি ছাত্রদের ওই হস্টেলে রাখা হবে না তা নিয়েই আমরা প্রশ্ন তুলি। তা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়।

যত দূর আমরা জানতাম, নতুন ওই হস্টেলে এগারোটি তল রয়েছে। সেখানে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের পরেও আরও অন্তত তিনটি তলা ফাঁকা পড়ে থাকবে। সেখানে খুব সহজেই অন্তত ১২০ জন ছাত্রকে রাখা যায়।

আমরা সেই প্রশ্ন তুললে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের রাখলে র‌্যাগিং হতে পারে। এমন একটা যুক্তি, যা আমাদের কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। দু’বছর ধরে কলেজে হস্টেলের জন্য কাউন্সেলিং পুরোপুরি বন্ধ ছিল। আসলে সরকারি ভাবে দেওয়ার মতো হস্টেলের কোনও ঘর ছিল না। কোনও রকম ভাবে ছাত্রদের সেখানে রাখা হতো। সেখানে নতুন বিল্ডিং হওয়ার পরে কেন সেই ছাত্ররা বঞ্চিত থাকবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন ছিল। যার উত্তর ছিল না কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে।

আমরা কয়েক দফায় প্রিন্সিপাল স্যরের কাছে যাই। তাঁর সঙ্গে কথা বলা খুব প্রয়োজন ছিল। অথচ তাঁর অফিসের সামনে রাত কেটে গেলেও স্যরের দেখা পাইনি। যা আমাদের ব্যথিত করে। এমনকি হস্টেল সুপার বহিরাগতদের নিয়ে এসে প্রিন্সিপালের অফিসে আমাদের উপরে চড়াও হয়। আমাদের মারধর করা হয়। অনেকে জখম হন। এক ছাত্রের পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। যা আমি এবং ছাত্ররা কেউই মেনে নেয়নি। এটা মানা যায় না। হস্টেল সুপারের দায়িত্বে থাকা যিনি এমন কাজ করেছিলেন তাঁকে নিয়েও আমাদের আপত্তি ছিল। আসলে ওই পদে যোগ্যতা দেখে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এর পরে অনশন ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। আমি অনশনে যোগ দিই। আমার সঙ্গে বন্ধুরাও ছিলেন। কষ্ট হয়েছে আমাদের প্রত্যেকের। সেই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু অন্যায়কে মেনে নেওয়ার সহ্য ক্ষমতা আমাদের মধ্যে নেই। কারণ, আমরা যা বলেছি তার প্রত্যেকটি কথা ও দাবি ছিল ন্যায়ের পক্ষে।

আমরা আশা করেছিলাম, প্রথমেই আমাদের এই দাবি মেনে নেওয়া হবে। দেরি হয়েছে অনেক। আমরা কিন্তু সেই দাবি থেকে সরে আসিনি। শেষ পর্যন্ত সবটা মেনে নেওয়া আমাদের জয়।

আমাদের দাবির মধ্যে যে কোনও অন্যায় ছিল না সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। মনে করি, এটা আসলে গোটা ছাত্র সমাজের জয়।

আপাতত ছ’মাসের জন্য আমাদের এগারো তলের বিল্ডিংয়ে জায়গা দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ছ’তলার বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে। ছ’মাসের মধ্যে ওই কাজ শেষ হবে। ওই বিল্ডিংয়েই আমাদের স্থায়ী ভাবে জায়গা দেওয়া হবে। তা আমরা মেনে নিয়েছি।

আমার মা (ললিতা রায় সরকার) ও বাবা (অমলেশবাবু) এসেছিলেন গ্রাম থেকে। গ্রাম মানে আমার বাড়ি। তাঁরা আমাদের সবার পাশে ছিলেন। আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার মনে হয় আমার বন্ধুদেরও ভাল লেগেছে। এমন আন্দোলনের সময় মা-বাবাকে কাছে পাওয়া অনেক সাহস জুগিয়ে দেয়।

আমার বাড়ি কোচবিহারের গীতালদহে। সীমান্ত ঘেঁষা ওই গ্রাম। গ্রাম্য পরিসরে বড় হয়েছি। সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা মা-বাবার কাছেই শিখেছি। হয়তো জানলে অবাক হবেন আমার গ্রামের মানুষই কতো অসুবিধে নিয়ে থাকেন। আমাদের গ্রামে কোনও (এমবিবিএস) চিকিৎসক নেই। নেই কোনও ল্যাবরেটরি। কেউ অসুস্থ বোধ করলে হয় দিনহাটা অথবা কোচবিহারে যেতে হয়। অনেকে কোচবিহার শহরে সারা দিন চিকিৎসক, রক্ত পরীক্ষা সব শেষ করে বাড়ি ফিরতে পারেন না। কিছু দিন আগে আমার মা অসুস্থ হয়ে ল্যাবরেটরি-ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেননি। ওই শহরেই থাকতে হয়েছে।

তাই, ন্যায় ও মানুষের পাশে চিরদিন থাকা আমার কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। চিকিৎসক হয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করাকেই ধর্ম হিসেবে মেনে নেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Medical College,Kolkata Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE