Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আঁধার ঘোচাতে গ্রামে প্রচার ভূমিজ মুন্ডাদেরই

সাপে ছোবল মারলে ওঝা নয়, যেতে হবে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। পেটে ব্যথা, জ্বরেও গুণিন-হাতুড়ে নয়, চিকিত্সকের কথামতো ওষুধ খেতে হবে। আর ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতেই হবে। কারণ, একমাত্র শিক্ষার আলোই পারে জীবনের অন্ধকার ঘোচাতে।

আগুয়ান: ভূমিজ মুন্ডাদের সচেতনতা সম্মেলন। বেলপাহাড়ির ধবাকাচা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।

আগুয়ান: ভূমিজ মুন্ডাদের সচেতনতা সম্মেলন। বেলপাহাড়ির ধবাকাচা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৪০
Share: Save:

সাপে ছোবল মারলে ওঝা নয়, যেতে হবে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। পেটে ব্যথা, জ্বরেও গুণিন-হাতুড়ে নয়, চিকিত্সকের কথামতো ওষুধ খেতে হবে। আর ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতেই হবে। কারণ, একমাত্র শিক্ষার আলোই পারে জীবনের অন্ধকার ঘোচাতে।

সরকার বা বিজ্ঞান মঞ্চের উদ্যোগে নয়, জঙ্গলমহলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে এ সব বোঝাচ্ছেন আদিবাসী ভূমিজ মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাই। অশিক্ষা, কুসংস্কার আর নেশার প্রভাব থেকে নিজেদের সম্প্রদায়কে বাঁচাতে এই উদ্যোগ ‘পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ভূমিজ মুন্ডা কল্যাণ সমিতি’র। সংগঠনের শিক্ষিত প্রতিনিধিরা বিশেষ ভাবে সচেতন করছেন মহিলা ও নতুন প্রজন্মকে।

সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক পুরুলিয়ার বলরামপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মীনারায়ণ সিংহ সর্দার জানালেন, এক সময় এই সম্প্রদায়ের লোকজন ব্রিটিশ বিরোধী চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তাঁরা তিমিরেই থেকে গিয়েছেন। সংগঠনের দাবি, রাজ্যে প্রায় চার লক্ষ ভূমিজ মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। তাদের ৫০ শতাংশেরও বেশি নিরক্ষর। ডাইনি প্রথার মতো নানা অন্ধ বিশ্বাস তাঁদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তাই অসুখে এখনও তাঁদের ভরসা ওঝা বা জানগুরু। স্কুলছুট ও কাঁচা বয়সে বিয়েও হচ্ছে আকছার। সর্বোপরি ভূমিজদের একাংশ নেশায় ডুবে ছারখার করছেন সংসার।

নিজেদের সংস্কৃতিও হারাতে বসেছেন ভূমিজ মুন্ডারা। ভূমিজদের ভাষা ‘হড় কাজি’ কার্যত লোপ পেতে বসেছে। শুধু ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার কিছু অংশে এই ভাষার চল। রাজ্যে ভূমিজদের লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র ধারাও বিলুপ্তপ্রায়।

পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক লক্ষ্মীনারায়ণবাবু বলছিলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষ গঙ্গানারায়ণ সিংহ, ফতে সিংহরা চুয়াড় বিদ্রোহের প্রথম সারিতে ছিলেন। সেই গৌরবময় অতীত মনে করিয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-চেতনার সার্বিক পরিবর্তন ঘটাতেই অঞ্চল ভিত্তিক সম্মেলন করছি।’’ ইতিমধ্যেই ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, রাইপুর, পুরুলিয়ার হুড়া, বলরামপুর ব্লকে সচেতনতা কর্মসূচি হয়েছে। ৭ জানুয়ারি বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা অঞ্চল সম্মলেন হবে গিধিঘাটি গ্রামে। ভুলাভেদার বাসিন্দা ভূমিজ মুন্ডা সম্প্রদায়ের তরুণ আশিস সর্দার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতক। পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার আশিস বলেন, “শিশুদের স্কুলে পাঠাতে, নাবালিকা বিয়ে আটকাতে এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে গ্রামে গ্রামে প্রচার করছি। ভাল সাড়াও মিলছে।”

আদিবাসী সমাজের মধ্যে থেকেই প্রচারের তাগিদটা উঠে আসায় তা সচেতনতা বিস্তারের কাজ সহজ হবে বলে মনে করছে প্রশাসন। ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আর অর্জুন মানছেন, ‘‘দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ। এ ভাবে সবাই এগিয়ে এলে কুসংস্কার ও নানা সামাজিক সমস্যা নির্মূল করা সহজ হবে।’’ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তীরও বক্তব্য, ‘‘সচেতনতা প্রসারে এমন মানুষজনকে আমরা সাথী হিসেবে পেতে চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE