দিন-বার-তিথি দেখে দোকান খুলতে হবে ক্ষৌরকার এবং মাংস বিক্রেতাদের! এমনই নির্দেশ বাজার কমিটির। কারণ জানতে চাইতে কমিটির সম্পাদকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বৃহস্পতিবার এলাকার কেউ মাংস খান না কি? ওই দিন কেউ সেলুনে চুল, দাড়িও কাটেন না।’’ নন্দকুমার বাজার কমিটির এমন নির্দেশিকায় বেধেছে বিতর্ক।
জাতীয় সড়ক থেকে এক কিলোমিটার দূরে ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই নন্দকুমার বাজার। এখানে সাড়ে পাঁচশোর বেশি দোকান রয়েছে। প্রতি রবিবার সাপ্তাহিক দোকান বন্ধের দিন। তবে গত ৭ মে বাজার কমিটির তরফে এক নোটিস ঝোলানো হয়েছে। সেখানে বাজারের মাংস বিক্রেতা এবং সেলুন মালিকদের ‘অনুরোধ’ করা হয়েছে প্রতি বৃহস্পতিবার, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী, শিব চতুর্দশী, নীলের বার, বড় রথযাত্রায় দোকান বন্ধ রাখতে হবে। নন্দকুমার বাজার উন্নয়ন সংস্থার সম্পাদক গৌরহরি সাউট্যার দাবি, ‘‘এলাকায় কেউ বৃহস্পতিবার মাংস খান না। সেলুনে চুল-দাড়িও কাটেন না। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই সব বিশেষ দিন-তিথিতে দোকান বন্ধ রাখার মৌখিক নিয়ম ছিল। কিছু নতুন দোকানদার নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। তাঁদের অনুরোধেই বাজার কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখিত নির্দেশিকা দিয়েছে।’’
ধর্মীয় আচার এবং রীতিনীতির ফারাকে একই এলাকায় মানুষজনের খাদ্যাভ্যাস ভিন্ন। অনেকে বিশেষ দিনে নিরামিষ খেলেও অনেকেই আবার খান না। চুল-দাড়ি কাটার ক্ষেত্রেও লোকজনের ভিন্ন মত কাজ করে। ওই বাজারে নন্দকুমার ব্লক ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মহিষাদল ব্লকের অমৃতবেড়িয়া, নামালক্ষ্যা পঞ্চায়েত এলাকা থেকে কয়েক হাজার বাসিন্দা আনাজ এবং মাছ-মাংস কিনতে আসেন। সর্বসাধারণের সেই বাজারে বিশেষের আচার-রীতির নিরিখে দোকান বন্ধের নির্দেশ কি কার্যত ‘ফতোয়া’ নয়? প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ ক্রেতা থেকে যুক্তিবাদী সংগঠন 'পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ'।
বিজ্ঞান মঞ্চের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলী সদস্য তথা ঢেকুয়া অগ্রণী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্রনাথ গায়েন বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানের দিন মাংসের দোকান আর সেলুন বন্ধ রাখা যায় কি? বাজার সমিতির নির্দেশিকা আইনত অনুচিত। যুক্তি সম্মতও নয়।’’ ওই বাজারের নিয়মিত ক্রেতা সৌমেন ভুঁইয়া বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার বা বিশেষ উৎসবের দিনে আমাদের মাংসের প্রয়োজন হতে পারে। এতে অনেকেরই অসুবিধে হচ্ছে। বাজার সমিতির এই নির্দেশিকা ঠিক নয়।’’ এলাকার একাধিক রেস্তরাঁর মালিক জানাচ্ছেন, বাজারের দোকান বন্ধ থাকায় প্রতি বৃহস্পতিবার হাই রোডের কাছে মাংসের দোকান থেকে তাঁদের কেনাকাটা করতে হয়।
এমন নির্দেশিকা সমর্থন যোগ্য নয়, বলছেন তৃণমূল পরিচালিত নন্দকুমার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শিবানী দে কুণ্ডু-ও। তিনি বলেন, ‘‘লিখিত নির্দেশিকার বিষয়টি আগে নজরে আসেনি। যাঁর ভাল লাগবে, তিনি মাংস কিনবেন, সেলুনে যাবেন। একটা বাজারে তো কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য হতে পারে না। এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া যায় না।’’ আবার বিজেপির জেলার (তমলুক) কমিটির নেতা সুকুমার বেরা বলছেন, ‘‘পারস্পরিক সম্পর্কের খাতিরে আমরা এটাকে সকলে মান্যতা দিই। তবে যদি কারও আপত্তি থাকে, তাঁরও অধিকার রয়েছে সঠিক উপায়ে প্রতিবাদ করার।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)