Advertisement
১৮ মে ২০২৪

মুখচোরা মেয়েরাই এখন ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’

দেবীপক্ষের পড়ন্ত বিকেল। স্কুল প্রাঙ্গণে ঐশিকী, পায়েল, কেয়া, অরুন্ধতীদের মতো জনা চল্লিশ ছাত্রী হাত মুঠো করে ‘ব্লক’ করছে প্রতিপক্ষকে। বুকভরা শ্বাস নিয়ে ইস্পাতকঠিন হাত দিয়ে ভেঙে টুকরে টুকরো করে দিচ্ছে টালির পাটাতন।

স্কুলে চলছে ক্যারাটে অনুশীলন। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

স্কুলে চলছে ক্যারাটে অনুশীলন। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৪৮
Share: Save:

দেবীপক্ষের পড়ন্ত বিকেল। স্কুল প্রাঙ্গণে ঐশিকী, পায়েল, কেয়া, অরুন্ধতীদের মতো জনা চল্লিশ ছাত্রী হাত মুঠো করে ‘ব্লক’ করছে প্রতিপক্ষকে। বুকভরা শ্বাস নিয়ে ইস্পাতকঠিন হাত দিয়ে ভেঙে টুকরে টুকরো করে দিচ্ছে টালির পাটাতন। কীভাবে ডান পায়ের ‘ব্যাক হুক কিক’ মেরে আক্রমণকারীকে জব্দ করতে হয়, সেটাও অনায়াসে করে দেখাচ্ছে তারা। টানা ছ’মাস স্কুলে ক্যারাটের প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌমিতা, প্রেরণা, কেয়া, পায়েলরাই হয়ে উঠেছে ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’! ঝাড়গ্রাম রানি বিনোদমঞ্জরী রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের এই পড়ুয়ারা লজ্জাবতী কিশোরীর আগল ভেঙে বাস্তব জীবনে অবাঞ্ছিত অসুরদের মোকাবিলা করতে শিখেছে।

এই যেমন মাস খানেক আগের কথা। অষ্টম শ্রেণির ঐশিকী কুণ্ডু নাচের দিদিমণির ক্লাস সেরে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। আচমকা রাস্তার কিছু বখাটে ছেলে ঘিরে ধরে উত্যক্ত করতে শুরু করে দেয়। সাইকেল ধরে টানাটানিও করে ওদের এক জন। মুহূর্তে সাইকেল থেকে নেমে ছেলেটিকে লক্ষ করে ডান পায়ের ব্যাক হুক কিক করে ঐশিকী। ঐশিকীর কথায়, “কিকের কেরামতিতে ছিটকে পড়ে উত্যক্তকারী। অবস্থা বেগতিক দেখে বাকি ছেলেগুলোও চম্পট দেয়।” ঐশিকীর সহপাঠী অরুন্ধতী মণ্ডলও কিছুদিন আগে এমন পরিস্থতির শিকার হয়েছিল। অরুন্ধতীর কথায়, “স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় কতগুলো ছেলে অনবরত বাজে মন্তব্য করছিল। এতটুকুও ভয় না পেয়ে রুখে দাঁড়াই। ডান হাতে ‘আপার ব্লক’ করে প্রতিরোধ করতেই পড়ি মরি করে সব দে ছুট।” এ রকমই প্রতিদিন পথে ঘাটে ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা খুঁটিনাটি সমস্যার সমাধান নিজেরাই করে ফেলছে অরুন্ধতীরা।

পড়ুয়াদের সবলা হিসেবে গড়ে তোলার এই কর্মসূচিটি একান্তভাবেই প্রধান শিক্ষিকা পুষ্পলতা মুখোপাধ্যায়ের ভাবনাপ্রসূত। পুষ্পলতাদেবীর কথায়, “আমি খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে। জীবনে বড় হয়ে ওঠার সময় বুঝেছি, শুধু পড়াশোনা নয়, ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া ভীষণই জরুরি। সেই লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ।” তাঁর দাবি, এ ধরনের প্রশিক্ষণের ফলে, ছাত্রীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটাও ভীষণ রকম বেড়ে গিয়েছে। প্রধান শিক্ষিকার ব্যবস্থাপনায় গত ডিসেম্বর থেকে স্কুল ছুটির পরে ষষ্ঠ থেকে দশম বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রীদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। প্রশিক্ষণের জন্য লাজুক ও মুখচোরা ছাত্রীদের বেছে নেওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিশিষ্ট ক্যারাটে কোচ গৌরাঙ্গ পালের তত্ত্বাবধানে ছাত্রীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন চলছে। দশম শ্রেণির মৌমিতা চক্রবর্তী গত মাসে জেলাস্তরের ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে চতুর্থ হয়েছে। ক্যারাটে-প্রশিক্ষক গৌরাঙ্গবাবুর কথায়, “আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে সুফল পাচ্ছে।”

ষষ্ঠ শ্রেণির কণিকা পাল, চৈতালি মল্লিক, সপ্তম শ্রেণির স্নেহা পালচৌধুরী, দশম শ্রেণির মৌমিতা চক্রবর্তীরা জানায়, “এখন মাথা উঁচু করে হাঁটি। ভয়কে জয় করতে শিখেছি।” ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সমর দাস বলেন, “খুব ভাল উদ্যোগ। বিনোদমঞ্জরীর এই ছাত্রীদের দেখে অন্য গার্লস স্কুলগুলিও অনুপ্রাণিত হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

karate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE