সরকারি খাতায় সেচ সেবিত এলাকা। বাস্তবে বেলপাহাড়ি ব্লকের চাকাডোবা গ্রামের কাজল সর্দার, পচাপানির বিশাখা রুইদাস, সিঙাডুবার চামুলাল সিংহ-রা ধান রোয়ার পর জলের জন্য চাতক-চোখে চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে।
বাম আমল থেকে পাহাড়, মালভূমি ও জঙ্গলে ঘেরা বেলপাহাড়ি ব্লকটি সরকারি ভাবে সেচসেবিত এলাকা। কিন্তু কৃষি ও সেচ দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেলপাহাড়ি ব্লকের মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ হল, ২১,৮৭০ হেক্টর। এর মধ্যে সেচের আওতায় মাত্র ৭,৫২৫ হেক্টর কৃষি জমি। অর্থাত্, চাষযোগ্য জমির মধ্যে মাত্র ৩৪ শতাংশ জমিতে সেচের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বেলপাহাড়ি ব্লকের দশটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত (বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা, শিমূলপাল, সন্দাপাড়া ও বেলপাহাড়ি) পাহাড়ি এলাকায়। ওই পাঁচটি এলাকায় এখনও প্রায় সাড়ে আট হাজার হেক্টর কৃষি জমি সেচের আওতার বাইরে রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সব থেকে বেশি চাষ হয় যে দু’টি জিনিস, সেই ধান আর আলু ফলাতে সর্বাধিক সেচ প্রয়োজন। অথচ, জেলাতে সেচসেবিত এলাকার পরিমাণ বেশি নয়। কৃষি দফতর জানিয়েছে, জুনে ২৩০ মিলিমিটার ও জুলাইয়ে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি প্রয়োজন।
সিমলা গ্রামের অনিল নায়েক বলেন, “সেচ নেই। বৃষ্টির অভাবে চাষ হয় না। তাই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা হুগলির হরিপালে নামাল খাটতে গিয়েছে।” হরিনারায়ণপুরের ভূতনাথ মাহাতো ও সিঙাডুবার চামুলাল সিংহদের মতো প্রান্তিক চাষিদের বক্তব্য, “এলাকায় বেশ কিছু প্রাকৃতিক ঝরনা রয়েছে। ওই সব ঝরনায় জোড়বাঁধ দিয়ে বর্ষার জল সংরক্ষণ করে রাখা গেলে সেচের সমস্যা হওয়ারই কথা নয়।’’
সমস্যা রয়েছে আরও। ধরা যাক মেদিনীপুর শহরের পাশে কাঁসাই নদীর অ্যানিকেতের কথা। যে জলের উপর মেদিনীপুর সদর, কেশপুর, খড়্গপুর-১ ও ২ ব্লক, পিংলা এবং ডেবরা ব্লকের ৮৭ হাজার একর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে অ্যানিকেত ভেঙে পড়ার পর থেকে টানা ৮ বছর সেচ মেলেনি। কিন্তু তা সেচসেবিত এলাকা হিসাবেই সরকারি খাতায় রয়েছে।
সেচে সব থেকে পিছিয়ে ঝাড়গ্রাম মহকুমা। ১৬৮৪৪৮ হেক্টর চাষ যোগ্য জমির মধ্যে ৯৯৯৪৫ হেক্টর জমিই বৃষ্টিনির্ভর! সেচসেবিত জমির পরিমাণ মাত্র ৬৮৫০৩ হেক্টর। ঘাটালে ৬৯৭৮৭ হেক্টর চাষ যোগ্য জমির মধ্যে ৫৫৭৫৪ হেক্টর সেচসেবিত, বৃষ্টিনির্ভর ১৪০৩৩ হেক্টর। মেদিনীপুর মহকুমার অন্য ব্লকগুলিতে সেচসেবিত এলাকা বেশি হলেও শালবনি একেবারে পিছিয়ে। ২৮৮৫৬ হেক্টর চাষ যোগ্য জমির মধ্যে ১২৬৭১ হেক্টর জমিই এখানে বৃষ্টি নির্ভর।
চাকাডোবার কাজল সর্দার, পচাপানির বিশাখা রুইদাস-রা বলেন, “সেচ থাকলে, সারা বছর ধান, সব্জি ও তৈলবীজ চাষ করা যেত।” জানালেন, আশির দশকে বাম সরকার কংসাবতী প্রকল্পের আপার ড্যাম তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেলপাহাড়ি ব্লকটিকে সেচ সেবিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু পাহাড়ি এলাকার জন্য কোনও সুষ্ঠু সেচবাঁধ হয়নি। এরপর থেকে এলাকার চাষিদের সেচ সেবিত এলাকার হারে জমির খাজনা দিতে হচ্ছে। অথচ পর পর দু’বছর বৃষ্টির অভাবে আমন ধান হয়নি।
এজন্য বেলপাহাড়ি ব্লককে খরা এলাকা ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তুলেছে কংগ্রেস ও বামেরা। মঙ্গলবার বেলপাহাড়ির বিডিও’কে প্রতীকী ঘেরাও করে বিক্ষোভও দেখান কংগ্রেস কর্মীরা।
তবে আশার কথা বাজেটে সেচের উন্নয়নে বিপুল বরাদ্দ ছাড়াও কেন্দ্রের কৃষি সিঞ্চন যোজনাতে পাইলট জেলা হিসাবে ধরা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরকে। চলতি আর্থিক বছরের জন্য এই জেলা ১৮৯ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প তৈরি করে জমাও দিয়েছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ টাকা মিলবে কিনা সংশয় থাকায় কৃষি দফতর আগামী তিন বছরে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প বানাতে চলেছে। কিন্তু সেচ প্রকল্পে তো এ বার ১৭ হাজার কোটি বরাদ্দ হয়েছে দেশ জুড়ে। রাজ্য পাবে কত?
বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা তথা ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেস সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “বাজেট বরাদ্দে হবেটা কী! এই রাজ্য সরকারের সেচের জল দেওয়ার মুরোদ নেই। কেবল লোক দেখানো উন্নয়ন হচ্ছে।” সরকারি সূত্রের দাবি, একসময় সেচ-সহ নানা স্থানীয় দাবিতে সোচ্চার হয়ে মাওবাদীরা এলাকাবাসীর সমর্থন আদায় করেছিল। সেজন্য বর্তমান সরকারের উন্নয়ন তালিকায় সেচকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের কৃষি ও সেচ কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ বলেন, “কয়েক বছরে আমরা বেলপাহাড়ি ব্লকে ২০টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প-সহ ১১২টি প্রকল্পে আরও ৮১৫ হেক্টর চাষ জমি সেচের আওতায় নিয়ে এনেছি।”
কৃষি দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর প্রভাত বসুর কথায়, “প্রকল্প তো জমা দিয়েছি। কিন্তু দেশ জুড়ে বরাদ্দ এত কম হলে আমরা কতটা পাব তা নিয়ে সংশয় তো থেকেই যাচ্ছে।” এ ব্যাপারে জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া ও সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের কথায়, “এতে সেচের কীই বা উন্নতি হবে। কৃষি বা কৃষকের স্বার্থে এই বাজেট নয়।”