E-Paper

শরীর-মন-সমাজ, নির্যাতিতার লড়াই তো চলে নিরন্তর

পূর্ব মেদিনীপুরের বছর বারোর এক ধর্ষিতা নাবালিকা ধর্ষণের পর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। আদালত তার গর্ভপাতের নির্দেশ দিলেও শারীরিক কারণে তা করা যায়নি।

দিগন্ত মান্না

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:১০
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শরীর-মনকে শোচনীয় ভাবে ধ্বস্ত করে দেওয়া অবর্ণনীয় এক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। শুধু স্থান-কাল-ক্ষণ আলাদা। এক জন নেহাতই বালিকা, অন্য জন তিরিশ পার করা গৃহবধূ। ধর্ষণের হিংস্রতার শিকার হয়েছিল দু’জনেই। ঘটনার পর থেকে আরও অনেক ধর্ষিতার মতো তারাও নিরন্তর ঘরে-বাইরে, শরীরে-মনে জীবনের মূল স্রোতে ফেরার অসম্ভব কঠিন লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও হারছে, কখনও জিতছে।

পূর্ব মেদিনীপুরের বছর বারোর এক ধর্ষিতা নাবালিকা ধর্ষণের পর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। আদালত তার গর্ভপাতের নির্দেশ দিলেও শারীরিক কারণে তা করা যায়নি। দিন কয়েক আগে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে সে। তখন থেকেই আরও একবার প্রশ্ন উঠেছিল, বর্তমান সামাজিক কাঠামোয় ধর্ষিতা বা তার সন্তানের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা, চেনা-পরিচিত পারিপার্শ্বিক গণ্ডী থেকে কাঙ্খিত সহমর্মিতা পাওয়া বাস্তবে কতটা সম্ভব? পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত উঠে আসছিল।

তখনই মনে হয়েছিল, অতীতে একইরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন কয়েকজন মহিলার জীবনের পাতা নেড়ে দেখা যাক। জীবনের স্রোতে ফেরার লড়াইয়ে তাদের পাশে কতটা দাঁড়িয়েছে সমাজ? কতটা উদারতা দেখাতে পেরেছে পরিচিত-পরিজনেরা?

বছর দশেকের সেই বালিকার কথাই প্রথমে ধরা যাক। তিন বছর আগে পূর্ব মেদিনীপুরেরই এক গ্রামে মোবাইলে কার্টুন দেখানোর নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে ধর্ষণ করেছিল প্রতিবেশী যুবক। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৭।

শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে দীর্ঘ একটা সময় তাকে এবং তার বাড়ির লোককে মামলার জন্য আদালতে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। বালিকাকে দিতে হয়েছে জবানবন্দি। সব মিলিয়ে ছাত্রীটির চেনা পরিসর যেন হঠাৎই অচেনা হয়ে উঠেছিল। যদিও নির্যাতিতার পাশে সে দিন দাঁড়িয়েছিল গোটা এলাকা। চলেছিল কাউন্সেলিং। স্কুলে যাওয়া শুরু করে নির্যাতিতা। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তার প্রতি অতিরিক্ত নজর দিতে শুরু করেন। সরাসরি সহপাঠীদের থেকে কোনও রকম কটূক্তিও তাকে শুনতে হয়নি। তবু আড়ালে তাকে নিয়ে পরিচিতদের কৌতূহল, ফিসফাস। পাড়ায় তাদের বাড়ি আলাদা ভাবে পরিচিত হওয়াটা পুরনো ক্ষতকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে দেয়নি। অতিরিক্ত সহানুভূতিও অনেক সময় যন্ত্রণা বাড়িয়ে তোলে।

তার উপর অভিযুক্ত যুবক মাস ছ’য়েক আগে জামিন পেয়ে আবার এলাকাতেই ফিরে এসেছে। প্রতিনিয়ত তাকে চোখের সামনে দেখে নিগৃহীতা বা তার পরিবার কি কখনও সুস্থ থাকতে পারবে? একই গ্রামে এ ভাবে থাকা সম্ভব? ক্ষোভে ফেটে পড়ে নাবালিকার মা বলেন,"অভিযুক্ত কী ভাবে জামিন পেয়ে গেল সেটাই বুঝতে পারছি না। আমরা আতঙ্কিত। আবার সে প্রতিহিংসা নিতে আমার মেয়ের উপর অত্যাচার করবে না তো! আমাদের ক্ষতি করবে নাতো?’’

আপাত ভাবে পরিবার-প্রতিবেশীদের সহযোগিতা পেয়েও একইরকম ভাবে গুটিয়ে রয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরেরই অন্য এক গ্রামের এক গৃহবধূ। কয়েক মাস আগে খেতে কাজ করার সময় এলাকারই এক যুবক তাঁকে ধর্ষণ করে। খবর পেয়েই পাড়ার ছেলেরা অভিযুক্তকে ধরে সে দিন পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। সকলকে পাশে পেয়েছিলেন। কিন্তু লড়াইটা তখনও খুব সহজ ছিল না, এখনও তা নয়।

নিজের স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকেদের প্রথমে ঘটনার ধাক্কা হজম করতে বা তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে। সামনে অনেকে সাহজ জোগালেও আড়ালে অনেকে সন্দেগ করেছেন, কটূ কথা বলেছেন। পুকুর ঘাট, পাড়ার আড্ডা, পুজোয় স্বাভাবিক মেলামেশা হারিয়ে গিয়েছে তাঁর জীবন থেকে। তিনিও যেমন দ্বিধা কাটিয়ে যেতে পারেন না, তেমনই তাঁকেও আগের মতো কেউ ডাকে না। তাঁর সন্তানকেও কখনও-কখনও মা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়। তাঁর কথায়, ‘‘সেই ঘটনার পর নিজেকে যেন অস্পৃশ্য মনে হয়। ’’

বর্তমানে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি তথা সমাজতাত্ত্বিক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় ধর্ষিতাদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরার প্রক্রিয়াকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ধর্ষণের ঘটনার স্মৃতি থেকে যায় সেই ‘কম্যুনিটি’ বা এলাকা এবং পরিবারের মধ্যে। তাকে ভোলা সহজ নয়। ‘জানিস তো আমাদের পাড়ায় ওই বাড়িটায় ওই মেয়াটার সঙ্গে এমন হয়েছিল’—এই আলোচনাটাই ধর্ষিতার ‘স্টিগমা’ বা মানসিক ক্ষত জিইয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। তার উপর কিছু লোকের বিকৃত আনন্দ হয় এই সব বিষয় নিয়ে রসালো আলোচনা করে। সেটাও মারাত্মক।’’তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘‘বিবাহিত মহিলার ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামান্য পারিবারিক ঝগড়ায় হয়তো অসতর্ক ভাবে ওই প্রসঙ্গ উঠে আসে। ধর্ষিতার সন্তানকে পরিবারে এবং সমাজে বিরূপতার সামনে পড়তে হতে পারে।।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

East Midnapur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy