ছত্তীসগঢ়ে লাগাতার পুলিশি অভিযানে কোণঠাসা মাওবাদীরা বিকল্প আশ্রয় খুঁজছে। তবে পুরনো আস্তানা এ রাজ্যের জঙ্গলমহলে তাদের নজরে নেই। পরিবর্তে, তাদের নজর এখন কলকাতা শহরতলি এবং কাছের জেলা নদিয়ার শহরাঞ্চলে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের এমনই দাবি।
সূত্রের খবর, পুলিশের সঙ্গে ‘সংঘর্ষে’ পর পর শীর্ষ মাওবাদী নেতার মৃত্যু এবং স্কোয়াড সদস্যদের আত্মসমর্পণের ঘটনায় কিছুটা দিশাহারা অতি-বাম সংগঠনটির নেতৃত্ব। ছত্তীসগঢ় লাগোয়া ওড়িশার মালকানগিরি, কন্ধমাল, ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূমের সারান্ডার জঙ্গলের দিকে মাওবাদীদের অবশিষ্ট দলটি সরছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাতেও মাওবাদী বিরোধী অভিযান হচ্ছে।
তবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ রাজ্যের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ফেরার সম্ভাবনা প্রায় নেই। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলকে আর নিরাপদ মনে করছে না তারা। কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপই এর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতি গ্রামে ভিলেজ পুলিশের নজরদারি, প্রত্যন্ত গ্রামের যুবকদের সিভিক কর্মী হিসাবে নিয়োগ, আত্মসমর্পণ করা প্রাক্তন মাওবাদীদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে পুলিশের চাকরি দেওয়া—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে সামাজিক প্রতিরোধ।
বেলপাহাড়ি থেকে ঝাড়খণ্ড সীমানা—পর্যটনকে কেন্দ্র করে বদলেছে এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ আজ হোম-স্টে, স্থানীয় ব্যবসায় যুক্ত। পর্যটকদের তথ্যও রোজ জেলা পুলিশের ‘ডেটাবেসে’ তোলা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষার পরিকাঠামো-সহ বদলে যাওয়া এই জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের জনসমর্থন আদায় সম্ভব নয় বলেই দাবি পুলিশের।
ঝাড়গ্রামের জেলা পুলিশসুপার অরিজিৎ সিনহা বলছেন, “জঙ্গলমহল মাওবাদী শূন্য। মাওবাদীদের ফিরে আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। সে ব্যাপারে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের আগাম সতর্কবার্তাও নেই। তবে নিয়মিত নজরদারি চলছে।”
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পুরুলিয়ায় রাজ্য পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের হাতে ধরা পড়েন সিপিআই (মাওবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সব্যসাচী গোস্বামী। সূত্রের খবর, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, জঙ্গলমহলের বদলে, নদিয়া ও কলকাতা লাগোয়া শহরতলিতে সংগঠন বিস্তারের চেষ্টা করছে মাওবাদীরা।
আগে আমনের মরসুমে খেতমজুর সেজে মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে ঢুকত। সে ঝুঁকি আর তারা নেবে না বলেই মত গোয়েন্দাদের। বরং, শহরাঞ্চলে সক্রিয় অতি-বামপন্থী ও গণ আন্দোলনমুখী কিছু সংগঠন সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্টে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, সেগুলি আদতে মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠন। সব্যসাচী ছাড়াও, ধৃত আরও দুই মাওবাদীকে জেরা করে এমনই তথ্য মিলেছে বলে খবর।
কিন্তু শহরে বা শহরতলিতে কেন? মনে করা হচ্ছে, ঘনবসতির ভিড়ে কে পাশের ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে এল, কে একা থাকে, কে কখন আসা-যাওয়া করছে, তা নিয়ে অন্যদের কৌতূহল থাকে না বললেই চলে। সেই সুযোগ নিতে ‘সেফ হাউজ়’ হিসেবে কলকাতা থেকে কিছুটা দূরের শহুরে এলাকা তাদের পছন্দ।
তবে আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে, রাজ্যে অতি-বামদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশও সতর্ক। জঙ্গলমহলের সন্ত্রাসপর্বে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের মতে, ২০০৩ থেকে ২০১১ সালে মাওবাদীদের সক্রিয়তার পর্বে রাজ্যবাসীকে বহু মূল্য চোকাতে হয়েছে। আর কেউ ভুল করবেন না।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা দাবি করেছেন, “মাওবাদী সমর্থক হয়তো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে পারেন। তবে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব বা সক্রিয় ক্যাডারেরা আর এ রাজ্যে নেই। এ দিকে তাঁদের আসার সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)