Advertisement
E-Paper

সুর হারাচ্ছে জঙ্গলমহলের মশাখেদার গান

এই লৌকিক বিনোদন অনুষ্ঠানের নাম ‘মশাখেদা’। শীত পড়ার আগে গ্রামগঞ্জে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা যায়। অনুমান করা হয়, সে কারণে প্রাচীন কালে মশা তাড়ানোর এই প্রতীকী কর্মসূচি হতো বলে মনে করেন লোকসংস্কৃতি গবেষকেরা।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৪৪
তোড়জোড়: পাট-খড় পেঁচিয়ে তৈরি হচ্ছে পৈড়ান। নিজস্ব চিত্র

তোড়জোড়: পাট-খড় পেঁচিয়ে তৈরি হচ্ছে পৈড়ান। নিজস্ব চিত্র

ভোর রাতে প্রবল শব্দে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করছেন একদল কিশোর-যুবক। বাজনার সঙ্গে বিচিত্র ছড়া কাটছে তারা— ‘যা রে মশা যা/ পিঠ কুরি কুরি খা/ বড় ঘরের বড় মশা, মশা মাতলা লো/ মশা আসে হুহু হুহু/ যাবু কি না যাবু কহু কহু।’ আওয়াজ শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন ছেলে-বুড়োরাও। কালীপুজোর রাত ফুরোলেই সুবর্ণরেখার ধারে ধারে জঙ্গলমহল এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে এমন দৃশ্য ছিল বড়ই চেনা। প্রযুক্তির যুগে তা হারিয়ে যেতে বসেছে।

এই লৌকিক বিনোদন অনুষ্ঠানের নাম ‘মশাখেদা’। শীত পড়ার আগে গ্রামগঞ্জে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা যায়। অনুমান করা হয়, সে কারণে প্রাচীন কালে মশা তাড়ানোর এই প্রতীকী কর্মসূচি হতো বলে মনে করেন লোকসংস্কৃতি গবেষকেরা। প্রচলিত বিশ্বাস, এ ভাবে মশা তাড়ালে আগামী কয়েক মাস মশার উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যায়। জঙ্গলমহলের দুই বর্ষীয়ান লোকসংস্কৃতি গবেষক মধুপ দে ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, এই কর্মসূচির ফলে মশা নির্মূল হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েক দশক আগেও মশাকে কেন্দ্র করে জঙ্গলমহলে এটিই ছিল কালীপুজো ও বাঁদনা পরবের সঙ্গে অন্যতম আকর্ষণীয় লৌকিক বিনোদন অনুষ্ঠান। মূলত, জঙ্গলমহলের দরিদ্র মূলবাসীরাই এই অনুষ্ঠানে সামিল হতেন। এই অনুষ্ঠানটি মূলত ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ। এখন অবশ্য হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ লৌকিক বিনোদন অনুষ্ঠানগুলি। ঠিক যেমন কালীপুজোর পরের দিন প্রতিপদ তিথিতে ‘পৈড়ান’ লোক উত্সবটিও এখন বিলুপ্তপ্রায়।

ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর, বেলিয়াবেড়া, সাঁকরাইল ব্লকের বেশ কিছু গ্রামে এখনও ‘মশাখেদা’র অনুষ্ঠান হয়। সাঁকরাইলের ভগবানচকের প্রবীণ বাসিন্দা মদন বেরার কথায়, “এখন দলে বেশি লোক পাওয়া যায় না। কিন্তু ছোটবেলায় দেখেছি ‘মশাখেদা’য় গোটা গ্রামের ছেলেবুড়োরা হাজির হতো। ছড়া শোনার জন্য জানলায় কান পেতে উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকতেন মা-পিসিরা।”

বেলিয়াবেড়ার ভোল গ্রামের শ্রীকান্ত দিগার, সাঁকরাইলের হাড়পড়িয়া গ্রামের মুরলী খিলাড়িদের আক্ষেপ, “এখন তো মশা মারার নানা রকম উপকরণ বাজারে এসেছে। নবীন প্রজন্মের ছেলেরা তাই ‘মশাখেদা’র ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। কিন্তু এই কর্মসূচি মূলত আনন্দানুষ্ঠান।” সূর্যোদয়ের আগেই ‘মশাখেদা’র দলের সদস্যেরা ‘মশা তাড়িয়ে’ নিজেদের বাড়িতে ফিরে যান। দলের ছেলেরা বাড়ি ফেরার পর তাঁদের হাতে-পায়ে তেল মালিশ করে দেন মা-ঠাকুমারা। অড়হর পাতা, শশা ও হিং দিয়ে তৈরি এক ধরনের পাঁচন খাওয়ানো হয় তাঁদের। প্রচলিত বিশ্বাস, ওই পাঁচন খেলে মশা বাহিত অসুখ হয় না।

প্রতিপদের দুপুরে হয় পৈড়ান উত্সব। মাটিতে গভীর গর্ত খুঁড়ে শিকড় সমেত পাটগাছ (স্থানীয় নাম কাঙ্গুরা) খড়ের সঙ্গে পেঁচিয়ে বিনুনির মতো করে পুঁতে দেওয়া হয়। মাটির উপরে থাকা চুলের বিনুনির মতো পাটগাছের ছালটিকে গাঁদাফুল ও পিটুলি বাটা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়। প্রত্যেক গ্রামের দু’তিনটি পাড়ায় এ ভাবে ‘পৈড়ান’ পোঁতা হয়। বেলা দ্বিপ্রহরে বাজনা সহকারে গ্রামের এক দল বলবান যুবক, বিশেষত খেতমজুরেরা ‘পৈড়ান’ তুলতে আসেন। যিনি বা যাঁরা হাতের শক্তিতে ‘পৈড়ান’ উপড়ে তোলেন, গ্রামের পক্ষ থেকে সেই বলশালীদের পুরস্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে চিঁড়ে-গুড় খাওয়ানোর প্রথা রয়েছে। শক্তিদায়িনী কালীপুজোয় গ্রামের ‘বাহুবলী’কে স্বীকৃতি জ্ঞাপনের জন্যই এই বিনোদনটি এখন হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় হয়।

যুগের চাহিদা বদলেছে। তাই হারিয়ে যেতে বসেছে জঙ্গলমহলের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

Man Jungle Mahals
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy