ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি চত্বরে এই ভাবেই জমে রয়েছে আবর্জনা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ ।
চিত্র-১: দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষে মাটিতে বসে পড়েছেন অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা। বেলা ১১টা ১০ মিনিট। তখনও হাসপাতালের বর্হিবিভাগে চিকিৎসক আসেননি।
চিত্র ২: ঘড়ির কাঁটায় ১১টা ২০ মিনিট। শিশু কোলে লাইনে দাঁড়িয়ে বাবা, মা, পরিজনেরা। বিনপুরের দুবরাজপুর গ্রামের বন্দনা দণ্ডপাট ছেলে স্বরূপকে নিয়ে ও ঝাড়গ্রাম ব্লকের রাজপাড়া গ্রামের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দেড় বছরের ছেলে মহেশ্বরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জানালেন, সকাল সাড়ে ন’টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। চিকিৎসক আসেননি।
চিত্র ৩: নাক-কান-গলা বিভাগেও দীর্ঘ লাইন। পশ্চিম মেদিনীপুরের খাকুড়দা হরি মাঝি, জামবনি ব্লকের বালিডিহার অভিলাস পাতর কানের সমস্যা নিয়ে এসেছেন। দু’জনেই সাড়ে ন’টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকের অপেক্ষায়।
এ তো গেল বর্হিবিভাগ। আরও নানা সমস্যায় জর্জরিত ঝাড়গ্রামের জেলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। গত বছর সুশ্রী প্রকল্পে ষষ্ঠ স্থানে থাকা এই হাসপাতালের স্থান এ বার নেমেছে পনেরোয়।
গত বছর এই প্রকল্পে ৮১ নম্বর পেয়ে ষষ্ঠ স্থানে ছিল এই হাসপাতাল। কিন্তু এ বার ৮৮ শতাংশ নম্বর পেয়েও রয়েছে ১৫ নম্বরে। নম্বর বাড়লেও প্রতিযোগিতায় অনেকখানি পিছিয়ে গিয়েছে জঙ্গলমহলের প্রাণকেন্দ্রের এই জেলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। পরিবেশ থেকে পরিষেবা, সর্বত্র সমস্যা। মেল মেডিসিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল ওয়ার্ডের পাশে শুয়ে দুই মানিসক ভারসাম্যহীন রোগী। চারদিক অপরিচ্ছন্ন। রোগীদের প্রধান অভিযোগ, খাবারের মান ও শৌচাগার নিয়ে। বাঁকুড়া জেলার রাইপুর ব্লকের ঢোকো গ্রামের সহদেব আহির মেল মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তিনি বললেন, ‘‘বাথরুমের অবস্থা খুব খারাপ। নোংরায় ভর্তি। আর খাবার খুবই খারাপ।’’ হাসপাতালে খাবারের মান নিয়ে কয়েক বছর আগে জামবনির একটি সভায় সরব হয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর কিছুদিন হাল ফিরলেও পরে ফের যে কে সেই। ওই ওয়ার্ডেই বেলপাহাড়ি ব্লকের পাথরচাকড়ি গ্রামের রামকিঙ্কর টুডু ভর্তি রয়েছেন। রামকিঙ্করও বলেন, ‘‘বাথরুম একেবারে জঘন্য।’’
বাইরে থেকে ওষুধ কেনার অভিযোগও রয়েছে। রামকিঙ্করের স্ত্রী সুদরী টুডুর কথায়, ‘‘স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড রয়েছে। তবুও বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে হচ্ছে।’’ জামবনি ব্লকের চিচিড়া গ্রামের বাসিন্দা চিকিৎসাধীন রঞ্জিতকুমারের রাউতও বলছেন, ‘‘স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড রয়েছে আমারও। তাও বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে।’’ হাসপাতাল সূত্রে খবর, একাধিক ওষুধ নেই। ফলে রোগীদের কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। আর হাসপাতালে শুধুমাত্র অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ইউএসজি হয়। হাসপাতালের পুরনো ভবনে নেই নিরাপত্তাও। সেখানে মানুষজনের অবাধ বিচরণ। ডায়ালিসিস ইউনিটের পাশে একই ঘরে মহিলা ও পুরুষ যক্ষ্মা রোগীরা রয়েছেন। ফুলকুসমার উমা গরাই, নেতুরার অনিলকুমার টুডু রয়েছেন একটি ঘরেই। বারান্দাতেও শুয়ে রয়েছেন কয়েকজন যক্ষ্মা রোগী।
একাধিক ওয়ার্ডে রয়েছে চিকিৎসকের ঘাটতি। মেডিসিন, সার্জারি, প্রসূতি, অর্থোপেডিক, চোখ, নাক-কান-গলার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগে যথেষ্ট চিকিৎসক নেই। জেনারেল ফিজিশিয়ান ৭০ জন থাকার কথা। সেখানে মাত্র ৩৫ জন রয়েছেন। ফলে বর্হিবিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসক বসেন না। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের ক্ষোভ, ‘‘এত বড় হাসপাতালে মাত্র দু’জন মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসক। কী ভাবে চলবে?’’ হাসপাতালের অক্সিজেন প্ল্যান্টটিও খারাপ হয়ে পড়েছে। সেই সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে রোগীদের। সিটি স্ক্যান ভবনের পাশে মেডিক্যাল বর্জ্য চার দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেখানে কুকুর টানাটানি করে ছড়াচ্ছে বর্জ্য।
প্রাক্তন বিধায়ক সুকুমার হাঁসদা প্রয়াত হওয়ার পর থেকে জঙ্গলমহলের এই হাসপাতালে রোগীকল্যাণ সমিতির পদটি ফাঁকা রয়েছে। দীর্ঘদিন বৈঠক না হওয়ায় নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে দিন দিন হাসপাতালে সমস্যা বাড়ছে বলেও সূত্রের দাবি। হাসপাতাল সুপার ইন্দ্রনীল সরকার অবশ্য ওষুধের খামতির কথা স্বীকার করেছেন। সুপার নিজেও বলছেন, ‘‘চিকিৎসকের বড় ঘাটতি রয়েছে। মেডিক্যাল বর্জ্য প্রতিদিন পরিষ্কার করার কথা। সমস্যা অনেক রয়েছে, তবুও এগিয়ে যেতে হচ্ছে।’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy