পাকা ঘরের সামনে নীলমণি ও দুর্বলা। নিজস্ব চিত্র
‘ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ’। অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা হওয়া উচিত। সংস্কৃত এই আপ্তবাক্যর পাশাপাশি পড়ুয়াদের সামাজিক শিক্ষার গুরুত্বও উপলব্ধি করেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সেই উদ্দেশ্যে সমাজের গরিব, অক্ষম মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেওয়া হয় ছাত্রছাত্রীদের। সেই শিক্ষা যে তাদের মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে তার প্রমাণ, মহিষাদলের একটি বেসরকারি ইরেজি মাধ্যমের স্কুলের পড়ুয়ারা তাদের টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে ঘর তৈরি করে দিল এলাকার কয়েক জন দুঃস্থ মানুষের।
মহিষাদলের মধ্যহিংলি খালপাড়ে রং মিস্ত্রির জোগারদার নীলমণি হাইত ও দুর্বলা হাইত-এর দিন কাটত ঝুপড়িতে। ষাটোর্ধ্ব ওই দম্পতিরই একতলা পাকা ঘর তৈরি হল স্কুলপড়ুয়াদের উদ্যোগে। পাশে থাকলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মহিষাদলের ওই স্কুল অ্যাপেক্স-এর লাগোয়া মধ্যহিংলি খাল। খালপাড়ে বহু মানুষের বাস। এঁদেরই একজন নীলমণি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বাস করছেন এখানে। এক সময় পাথর ভাঙতেন। বয়সেক ভারে আর সে কাজ করতে না পারায় রঙ মিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন। এখন অশক্ত শরীর। কাজ করার ক্ষমতা নেই। কালো পলিথিমের চাদরে মোড়া ঝুপড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটে নীলমণির। ছেলেমেয়ে বলতে তিন মেয়ে। সকলেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অভাবে কোনওমতে দিন কাটে। মাথার ওপর পাকা ছাদ ও শৌচাগার পেয়ে বেজায় খুশি দম্পতি। নীলমণির কথায়, ‘‘এখন আর খাটতে পারিনা। চল্লিশ বছর ধরে খালপাড়ে এই ঝুপড়িই ঠাঁই। ঝড়-বাদল হলেই হাওয়ায় ঝুপড়ি ভেঙে যায়। স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য ঘর পেলাম।’’ স্ত্রী দুর্বলার কথায়, ‘‘স্কুলের ছেলেমেয়েগুলো টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে টাকা দিয়েছে শুনেছি। ওদের ভাল হোক।’’
পড়ুয়াদের এমন সামাজিক উদ্যোগে খুশি স্কুল কর্তৃপক্ষও। স্কুলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হরিপদ মাইতি ও সভাপতি দেবাশিস মাইতি জানান, স্কুলের পাশেই নীলমণির ঝুপড়ি। ছেলেমেয়েরা তাদের টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে ৫০ হাজার টাকা তুলেছে। পড়ুয়াদের এই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন শিক্ষক–শিক্ষিকারাও। স্কুলও কিছু আর্থিক সাহায্য করেছে। তবে সবার আগে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগের প্রশংসা করতে হয়।’’ স্কুলের তরফে জানানো হয়েছে, মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। স্কুল পরিচালন কমিটির তরফে সোমেশ সাঁতরা জানান, আগেও এ ধরনের আর্থিক সাহায্য করেছিল স্কুলের পড়ুয়ারা।
স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল নয়নতারা রায় বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েদের জীবনের শিক্ষা দিতেই এই উদ্যোগ। পড়শির পাশে থাকা বা দুঃস্থদের সাহায্য করার মাধ্যমে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয়। অভিভাবকরাও সাহায্য করেছেন। এর আগেও অনাথ আশ্রমের জন্য বাড়ি থেকে আনা আলু-সবজি তুলে দিয়েছে স্কুলের পড়ুয়ারা।’’ আর কী বলছে ওই পড়ুয়ারা! দশম শ্রেণির এক পড়ুয়ার বক্তব্য, ‘‘ক্লাসঘর থেকে দেখতাম নীলমণিদাদুর ওই কালো ত্রিপলে ঢাকা দুপড়ি রোজ নজরে পড়ত। ঠিক করি আমরা সবাই চাঁদা তুলে ওঁকে সাহায্য করব। শিক্ষকদের জানালে ওঁরাও এগিয়ে আসেন। এখন ভাল লাগছে।’’
কিন্তু গৃহহীনদের তো সরকারি প্রকল্পে ঘর পাওয়ার কথা। কী বলছে স্থানীয় প্রশাসন? ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি প্রকল্পে ঘর পেতে হলে নিজস্ব জায়গা চাই। কিন্তু ওই গৃহহীন মানুষটির নিজস্ব জায়গা নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। নীলমণি ও দুর্বলা বলেন, ‘‘বার্ধক্য ভাতার জন্য আবেদন করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy