মৃত সৌরভ কুমার। (ফাইল চিত্র)
পরিজনেদের সঙ্গে শেষ বার কথা হয়েছিল হোয়াটস্ অ্যাপে। তারপর টানা তিন দিন মোবাইল বেজে গেলেও কেউ তোলেনি। উদ্বিগ্ন সহকর্মীরা রেল কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন বন্ধুর খোঁজে। অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়া মেলেনি। ঘরের ভিতর থেকে দুর্গন্ধ পেয়ে সন্দেহ হয় বন্ধুদের। শেষ পর্যন্ত পুলিশ এসে দরজা ভাঙলে উদ্ধার হয় বছর একত্রিশের রেল ইঞ্জিনিয়ার সৌরভ কুমারের বিকৃত দেহ।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। খড়্গপুর গোলবাজার মসজিদ সংলগ্ন রেল কোয়ার্টারের ঘটনা। বিহারের অখিলাবাদের বাসিন্দা সৌরভ খড়্গপুরে রেল কারখানার চিফ ডিপো মেটেরিয়াল সুপারিন্টেনডেন্ট পদে কর্মরত ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের দাবি ছিল, বিষক্রিয়ায় সৌরভের মৃত্যু হয়েছে। সেই মতো অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে তদন্তও শুরু করে পুলিশ।
ঘটনার খবর পেয়ে বিহার থেকে সৌরভের পরিজনেরা খড়্গপুরে আসেন। মৃতের পরিবারের লোকেদের দাবি ছিল, তাঁরা দাবি জানালেও পুলিশ খুনের মামলা রুজু করেনি। পুলিশের ভূমিকার সমালোচনায় তোলপাড় হয় গোটা দেশ। বিচারের দাবিতে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সরব হন সৌরভের বন্ধুরা। ঘটনায় প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু ট্যুইট করে জানান, “গোটা ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ পুলিশি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দোষীরা কেউ ছাড় পাবে না।”
ঘটনার সিবিআই তদন্ত চেয়ে বিভিন্ন মহলে চিঠিও দিয়েছেন তাঁরা। মৃতের দাদা বিপিন কুমারের অভিযোগ, “ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে আমরা বারবার বলেছি ওঁকে খুন করা হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছিল ওঁর ওপর ঠিকাদারদের চাপ ছিল।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘পুলিশ প্রথম থেকেই তদন্তে গাফিলতি করেছে। বিচারের আশায় সব মহলে যোগাযোগ করেছিলাম। এখনও বিচার পাইনি।”
ঘটনার তদন্তে সৌরভের একাধিক সহকর্মীকে জেরা করে পুলিশ। গত ৫ অক্টোবর সৌরভের কোয়ার্টারে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশিতে সৌরভের কোয়ার্টার থেকে মানসিক অবসাদ কমানোর ওষুধের কৌটো উদ্ধার হয়। পুলিশের ধারণা, মানসিক চাপ কমাতেই সৌরভ ওষুধ খেতেন। সৌরভের মোবাইলের কললিস্ট পরীক্ষা করা হয়। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, “ঘটনার তদন্তে নেমে আমরা অনেক সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওঁর সহকর্মীদের কেউ মুখ খোলেননি। সৌরভের মৃত্যু খুন না আত্মহত্যা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ময়না-তদন্তে সৌরভের মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হয়নি। ভিসেরা রিপোর্টও এলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।”
ঘটনার মাস তিনেক পর কে নাগরাজু ও কে লক্ষ্মণ রাও নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সৌরভ ছিলেন নাগরাজুর ঊর্ধ্বতন আধিকারিক। নাগরাজুর রেল কোয়ার্টারেই ভাড়ায় থাকতেন সৌরভ। পুলিশের সন্দেহ ছিল, সৌরভকে কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে বলেছিলেন নাগরাজু। কোয়ার্টার ফেরত দিতে না চাওয়ায় সৌরভকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে। পুলিশের অন্য এক সূত্রে দাবি, নাগরাজুর কোনও দুর্নীতির কথা সৌরভ জেনে ফেলেছিলেন। তাই তাঁকে খুন হতে হয়েছিল। এক পুলিশ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘আমাদের এখনও মনে হয় সৌরভ কুমার আত্মহত্যাই করেছিলেন। জেরায় ধৃত নাগরাজুর বক্তব্যে অসঙ্গতি পাওয়া যায়। নাগরাজুর মোবাইলের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার ফোন থেকে বারবার কে লক্ষ্ণণ রাওকে ফোন করা হয়েছে। তারপরেই লক্ষ্ণণ রাওকেও গ্রেফতার করা হয়।’’
ঘটনার পর পাঁচ মাস কেটে গিয়েছে। খড়্গপুরে সৌরভের কোয়ার্টারের উল্টো দিকের কোয়ার্টারের বাসিন্দা আশিস মোহান্ত, জ্যোৎস্না বেগমরা বলছিলেন, “নিজের মতোই থাকতেন সৌরভ। কারও সঙ্গে তাঁর খারাপ সম্পর্কও ছিল না। আজও ওঁর দেহ উদ্ধারের দিনের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।’’
ছেলেকে হারিয়ে অসুস্থ সৌরভের বাবা-মা। সৌরভের দাদা বিপিন কুমার বলছেন, ‘‘মা-বাবার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। আমরা এখনও ভাইয়ের মৃত্যুর বিচার পেলাম না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘যে পুলিশ আধিকারিকেরা ঘটনার তদন্ত করছিলেন তাঁরাও বদলি হয়ে গিয়েছেন বলে শুনেছি। নতুন অফিসারদের সঙ্গে কথা বলতে কয়েক দিনের মধ্যে খড়্গপুর যাব। আমরা চাইছি সত্যিটা সামনে আসুক।’’
আদৌ কী ঘটনার কিনারা হবে? খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেন, “ফরেন্সিক রিপোর্ট এখনও আসেনি। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও ওঁরা এখনও নিজেরা কিছু স্বীকার করেনি।’’ তিনি আরও বলছেন, ‘‘ঘটনাটি খুন না আত্মহত্যা তা ফরেন্সিক রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না। ঘটনার পর সব দিক থেকে নিশ্চিত হলেই আমরা চার্জশিট জমা দেব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy