সফল: নিজের স্বপ্নের কারখানায় সমিতাদেবী। নিজস্ব চিত্র
রাস্তায় নেমে ফেরি করবে বাড়ির বউ!
আত্মীয়-পরিজন, পড়শিদের এমন বাঁকা কথায় আত্মবিশ্বাস এক নিমেষে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সমিতা চট্টোপাধ্যায়ের মনের জোর এমন কটূক্তিতেও টাল খায়নি এতটুকু। বেরিয়ে পড়েছিলেন ফেরি করতে। ঝাড়গ্রামের গৃহবধূ সমিতা। এখন বিশিষ্ট মহিলা উদ্যোগপতি হিসাবেই বেশি পরিচিত।
স্বপ্নপূরণের লড়াই কীভাবে করতে হয় সেটা দেখিয়ে দেওয়া এক মহিলার নাম সমিতা। লড়াইয়ের দিনগুলো পুরনো যুগের ক্যামেরায় থাকা রিলের ছবির মতো পরপর মনে করতে পারেন সমিতা। শোনাতেও পারেন গল্পের মতো করে। আসলে তাঁর উত্থান পর্বটা গল্পকথার মতোই তো। সময়টা আশির দশকের শেষের দিকে। দু’হাতে দু’টো বড় বড় ব্যাগ নিয়ে পথে নামলেন তিনি। দু’টো ব্যাগে ভর্তি ঘরে ছাপানো চাদর। ব্যাগ দু’টোর ওজন নেহাতই কম নয়। তা নিয়েই বাড়ি বাড়ি ফেরি শুরু।
বাড়ির বউ কেন ফেরি করতে নামেন? এই সহজ প্রশ্নের উত্তরটা তো জানা থাকাই স্বাভাবিক। স্বামী রতন চট্টোপাধ্যায়ের আয় তখন খুবই কম। সামান্য ব্যবসা করেন। তাতে সংসারের সব দাবি ঠিকঠাক মেটানো যায় না। স্বামীর পাশে দাঁড়াতে চাইলেন সহধর্মিনী। স্বামীও অবশ্য পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। লোকজনের বাঁকা কথায় সমিতা সেইসময়ে একটু দোটানায় ছিলেন। ফেরি করতে পথে নামার সামাজিক চাপটা তাঁর ওপর কীভাবে পড়বে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাঁকে মনের জোর জুগিয়েছিলেন রতনবাবু। সমিতা নিজেই জানান, সেইসময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনও উৎসাহ দিয়েছিলেন।
শুধু মনের জোর আর কঠোর পরিশ্রমেই ফেরিওয়ালা থেকে উদ্যোগপতি হননি সমিতা। একটা স্বপ্নও ছিল তাঁর। সেই স্বপ্ন নিজের চাদর ছাপার কারখানা তৈরির। স্বপ্ন সফল হয়েছে তাঁর। ঝাড়গ্রাম শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে গেলেই দেখা মিলবে সমিতার স্বপ্ন। আট বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে তাঁদের কারখানা ‘টেক্সপ্রিন্ট’। সমিতা মনে করতে পারেন, স্বপ্ন দেখার জন্যও দেখতে হয়েছে কত তাচ্ছিল্যের মুচকি হাসি। সেইসময়ে তাঁর যা অবস্থা ছিল তাতে এক ফেরিওয়ালার মধ্যে কারখানার মালকিন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাননি পরিচিতেরা। এজন্য তাঁদেরও খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। সালটা ১৯৮৯। ঝাড়গ্রামেই একেবারে ঘরোয়া পদ্ধতিতে চাদর প্রিন্টের কাজ করতেন নিজের হাতেই। কাজ শিখেছিলেন এক ভাশুরের কাছে। ভাশুর গুজরাতের কাপড় কারখানায় টেক্সটাইল ডিজাইনার ছিলেন। ফলে সুবিধাই হয়েছিল সমিতার। বাজার থেকে গুলিসুতোর কাপড় কিনতেন। তারপর তাতে নিজের হাতে স্ক্রিন প্রিন্ট করতেন। সেই চাদরই ব্যাগ ভর্তি করে ঝাড়গ্রাম শহরের পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করতে হতো। তখনকার কাজের বহর? সারা দিনে মেরেকেটে ছ’টা চাদর প্রিন্ট করতে পারতেন তিনি।
কষ্ট করছেন, আর সেই সঙ্গে স্বপ্নও মনের মধ্যে চওড়া হচ্ছে সমিতার। ঝাড়গ্রামে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছিলেন না তিনি। নিজের শহরে তাঁর চাদরের কদর তখন বেশ ভাল। স্বামীর সঙ্গে যাতায়াত শুরু হল কলকাতায়। রাজধানীর মহাজনদের কাছে চাদর বিক্রি শুরু করলেন। পরিচিতি আরও বাড়ল। চাদরের প্রশংসাও ছড়াল। কিন্তু স্বপ্ন তখনও দূর অস্ত। তার বড় কারণ পুঁজির অভাব। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যাঙ্কে ঋণের জন্য দৌড়াদৌড়ি সেসময় কম করেননি। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। পুঁজির জোগানের জন্য চাদর বিক্রির লাভ জমাতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে চেষ্টা চলল পরিকাঠামো উন্নয়নের। একবার নিজেই চলে গেলেন গুজরাতে। সেখানে সরেজমিন দেখে এলেন বস্ত্র কারখানার কার্যপদ্ধতি। ফিরে এসে ঝাড়গ্রামে কারিগর দিয়ে কম খরচে একের পর এক যন্ত্র নিজেই তৈরি করিয়ে নিলেন। পুরো পরিকল্পনাটা নিজের। নতুন যন্ত্রে কাজে সুবিধা হল। ফলে ব্যাপক পরিবর্তন এল উৎপাদনে। চাদর প্রিন্ট শুরু হল অনেক বেশি সংখ্যায়। নকশাতেও এল বৈচিত্র। ক্রেতাদের আগ্রহে তৈরি হল নতুন নকশার চাদর।
ফল? আগে নিজে কলকাতায় যেতেন চাদর পৌঁছে দিতে। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলে বড়বাজারের আড়তদারেরা ঝাড়গ্রামে এসে চাদর নিয়ে যেতে শুরু করলেন।
সমিতা নিজের সংসারের হাল ফেরাতে পথে নেমেছিলেন। এখন তাঁর কারখানার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েকশো পরিবারের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যবস্থাতেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একটা চাদর তৈরি হয় আটটি স্তর পেরিয়ে। এখন চাদর ছাড়াও ‘টেক্সপ্রিন্ট’এ ছাপা হয় বালিশের ওয়াড়ও। রাজ্য সরকারের সংস্থা তন্তুজ এবং বঙ্গশ্রী নিয়মিত সমিতাদের চাদর কেনে। দেশের সবচেয়ে বড় চাদরের বাজার পানিপথের মাণ্ডিতেও তাঁদের চাদরের বিপুল চাহিদা রয়েছে। সমিতাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে বিদেশেও। স্থানীয় মানুষদের জন্য কারখানা চত্বরেই তৈরি করে নিয়েছেন চাদরের একমাত্র খুচরো বিক্রয় কেন্দ্র।
কিন্তু শুধু ব্যবসায়িক সুবিধার কথাই ভাবেন না সমিতা। তিনি পরিবেশের দিকেও নজর দেন। তাই কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৪ লক্ষ টাকায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসিয়েছেন। কারখানায় ব্যবহৃত জল ওই প্ল্যান্টে পরিশোধন করা হয়। তারপর সেই জল পুরসভার নিকাশি ব্যবস্থায় ফেলা হয়।
সমিতা এখন নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। শ্রমের এবং সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন সেরা মহিলা শিল্পোদ্যোগীর পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিজের তরফে তাঁকে শ্রেষ্ঠ মহিলা শিল্পোদ্যোগীর সম্মান দেওয়া হয়। পুরস্কার নিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডির হাত থেকে। কাজের সঙ্গে সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন সমিতা। ঝাড়গ্রাম শহরে একটি যোগাসন কেন্দ্র খুলেছেন। যোগাসনে জাতীয়, রাজ্য স্তরে বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
এখন কারখানা চত্বরেই সপরিবারে থাকেন সমিতা। স্বামী, ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। পরিবারের কথা উঠলে নিজেই জানান, তাঁর পরিবারের সদস্য কিন্তু কারখানার কর্মীরাও। কোনওরকম ব্যাঙ্ক ঋণ ছাড়াই ব্যবসায় লাভের পুঁজি দিয়েই তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন নিজের স্বপ্নের কারখানা। খুব ভাল করেই জানেন, শ্রমের সঙ্গে অনেকের সহযোগিতা, সহমর্তিতা না থাকলে সেই স্বপ্ন পূরণ হতো না। জীবনের চড়াই উতরাই পার হওয়া যেত না। তাই তাঁর পরিবারের ধারণাটা একটু বিস্তৃত।
সমিতার লড়াইয়ের মতোই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy