Advertisement
E-Paper

ওড়িশার রাজার দখলে ছিল কাশীআড়

প্রাচীন কলিঙ্গ ভূখণ্ডের অধীনে গড়ে ওঠা এক জনপদ কাশীআড়। চারিদিকে মঠ-মন্দিরে ঘেরা এই জনপদ বরাবর সড়ক যোগাযোগের মধ্যস্থল। রাজার অধীনে থাকা সেই জনপদই আজকের কেশিয়াড়। কেশিয়াড় থেকে অপভ্রংশের মাধ্যমে কেশিয়াড়ি নামের উৎপত্তি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই পুরনো এলাকার অনেকাংশেই গিয়েছে বদলে। গ্রাম্য চেহারায় লেগেছে শহুরে আধুনিকতার ছোঁয়া। মেঠোপথ বদলে গিয়েছে কংক্রিটের সড়কে।

দেবমাল্য বাগচী

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০৩:২৪
নতুন বসতি গড়ে উঠছে কেশিয়াড়িতে (বাঁ দিকে)। ভসরাঘাটে সুবর্ণরেখার উপর এই সেতু তৈরি হলে সহজেই ওড়িশা যাওয়া যাবে (ডান দিকে)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

নতুন বসতি গড়ে উঠছে কেশিয়াড়িতে (বাঁ দিকে)। ভসরাঘাটে সুবর্ণরেখার উপর এই সেতু তৈরি হলে সহজেই ওড়িশা যাওয়া যাবে (ডান দিকে)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

প্রাচীন কলিঙ্গ ভূখণ্ডের অধীনে গড়ে ওঠা এক জনপদ কাশীআড়। চারিদিকে মঠ-মন্দিরে ঘেরা এই জনপদ বরাবর সড়ক যোগাযোগের মধ্যস্থল। রাজার অধীনে থাকা সেই জনপদই আজকের কেশিয়াড়। কেশিয়াড় থেকে অপভ্রংশের মাধ্যমে কেশিয়াড়ি নামের উৎপত্তি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই পুরনো এলাকার অনেকাংশেই গিয়েছে বদলে। গ্রাম্য চেহারায় লেগেছে শহুরে আধুনিকতার ছোঁয়া। মেঠোপথ বদলে গিয়েছে কংক্রিটের সড়কে। রাস্তার দু’ধারে বহুতল পাকা বাড়ি, কলেজ, প্রেক্ষাগৃহ আধুনিকতা বয়ে এনেছে খড়্গপুর শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এই কেশিয়াড়িতে।
এটা তো গেল এখনকার চেহারা। কিন্তু আগে কেমন ছিল এই এলাকার চেহারা?
ইতিহাস বলছে, প্রাথমিকভাবে ওড়িশা ভূখণ্ডে থাকা কাশীআড় এলাকা পরিচালনা করতেন ওড়িশার রাজা মুকুন্দদেব। এখনও সুবর্ণরেখা নদীর ওপারে নয়াগ্রাম থেকে ওড়িশার সুলিয়াপদা হয়ে বারিপদা যাওয়ার রাস্তাই তার প্রমাণ দেয়। কেশিয়াড়ির বুকে থাকা মুকুন্দপুকুর নামে বিশাল জলাধার রাজা মুকুন্দদেবের রাজত্বের ইঙ্গিত দেয়। পরবর্তীকালে আকবরের আমলে এই এলাকা সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। সেই সময় সিংভূমের রাজা মানসিংহের কাছারি ছিল এই এলাকায়। বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ প্রবোধ ভৌমিক তাঁর ‘মেদিনীপুর কাহিনী’ শীর্ষক রচনায় লিখেছেন, ‘কেশিয়াড়ি ছিল বেশ শহরের মতো একটা জায়গা। আকবরের আমলে রাজা মানসিংহের কাছারি ছিল ওখানে। সেই সময়ে কেশিয়াড়ির সমৃদ্ধির অন্ত ছিল না।’ অবশ্য কেশিয়াড়িতে যে রাজা মানসিংহ ও মোগলদের আধিপত্য ছিল তা এখন সর্বজনগ্রাহ্য।

তবে আদি ‘কাশীআড়’ নাম ঘিরে রয়েছে নানা বিতর্ক। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, ‘আড়’ কথার অর্থ পথ। সুবর্ণরেখার তীরে কাশের জঙ্গলে ভরা পথ (আড়) থেকেই কাশীআড়। আবার অনেকে মনে করেন, স্থানীয় ভবানীপুরের কাশীশ্বর শিবের মন্দির যাওয়ার পথ থেকে কাশীআড় নামের উৎপত্তি। আর একাংশের মতে, এই পথ ধরেই বাংলার একাংশ তীর্থযাত্রী সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে উত্তরপ্রদেশের কাশীতে পৌঁছত। তাই এই এলাকার নাম কাশীআড়। আর সেই কাশীআড় অপভ্রংশের ফলে এখন কেশিয়াড়ি হয়েছে।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গিয়েছে সেই পুরনো কেশিয়াড়ি। খড়্গপুর ও বেলদা- দুই শহর থেকে সড়ক এসে মিলেছে সুবর্ণরেখা নদীর চর থেকে উঠে আসা দুই সড়কে। কার্যত এই চার রাস্তার মোড় হল কেশিয়াড়ির প্রাণকেন্দ্র। উত্তরে খড়্গপুর, দক্ষিণে ভসরাঘাট, পশ্চিমে কুলবনি ও পূর্বে বেলদা যাওয়ার সড়ককে কেন্দ্র করেই শহরের ছোঁয়া লেগেছে ব্লক সদর কেশিয়াড়িতে। বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মানুষ এসে কাজের সন্ধানে আসেন এই কেশিয়াড়িতে। বস্তুত, ঔরঙ্গাবাদ, কাঞ্চনপুর, কেশিয়াড়ি, মীর্জাপুরের মতো বহু মৌজা নিয়ে কেশিয়াড়িও একটি গ্রাম পঞ্চায়েত। তবে দিন যত এগোচ্ছে ততই মাটির গন্ধ হারাচ্ছে এই জনপদ। এক সময় থানা ছাড়া আর কোনও প্রশাসনিক দফতর ছিল না কেশিয়াড়িতে। তবে ছ’য়ের দশক থেকেই কেশিয়াড়ির প্রাণকেন্দ্রের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যালয় স্থাপিত হয়। মোরাম রাস্তা বদলে যায় পিচে। উন্নত পরিষেবার লক্ষ্যেও গ্রাম থেকে শহরে আসতে শুরু করেন অনেকে।

কেশিয়াড়ি শহরে দু’টি হাইস্কুল ছিলই। এখন একটি পলিটেকনিক কলেজ ও একটি ডিগ্রি কলেজও হয়েছে। এক কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে ব্লক প্রশাসনিক কার্যালয়, কৃষি দফতরের কার্যালয়, খাদ্য দফতরের মতো নানা কার্যালয়। এখানেই রয়েছে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। ২০১১ সালে উদ্বোধন হয়েছে ‘রবীন্দ্র ভবন’ নামে একটি প্রেক্ষাগৃহ। বদলে গিয়েছে ব্রিটিশ যুগের মাটির থানা। সম্প্রতি কেশিয়াড়ি থানা পেয়েছে নতুন ত্রিতল ভবন। চোখের সামনে পাল্টে যাওয়া স্মৃতি ভেসে ওঠে এক সময়ের জেলা পরিষদ সদস্য তথা অবসরপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রতাপচন্দ্র শীটের। বছর পঁচাত্তরের প্রতাপবাবু বলছিলেন, ‘‘তখন কলেজে পা রেখেছি। ছ’য়ের দশকে খড়্গপুর থেকে এই থানা পর্যন্ত রাস্তা ছিল মোরামের। আর থানা থেকে ভসরাঘাট ছিল মাটির রাস্তা। বেলদা রাস্তা মোরামের হলেও কুলবনির রাস্তা ছিল মাটির। দিনে দু’একটি বাস চলত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব বদলে গেল। আসলে আধুনিকতার সঙ্গে তাল না মিলিয়ে উপায় কী!’’

তবে এলাকায় নানা সমস্যাও রয়েছে। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মাধ্যমে কেশিয়াড়ির কিছু অংশে পানীয় জল সরবরাহ চালু হলেও সর্বত্র মেলে না নলবাহিত জল। ফলে জলসঙ্কটে পড়েন এলাকার বাসিন্দারা। কেশিয়াড়ি মোড় থেকে চারটি রাস্তার কিছুটা অংশে পথবাতি থাকলেও অধিকাংশ পথ এখনও আঁধারে ডুবে থাকে। নিকাশি সমস্যা নিয়ে জেরবার কেশিয়াড়িবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অশোক চৌধুরীর কথায়, ‘‘শহর যখন বাড়ছে তখন পরিকাঠামোগত উন্নতি প্রয়োজন। অবিলম্বে এগুলি না করলে শহরের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।’’ সমস্যা যে রয়েছে তা মানছেন বিডিও অসীমকুমার নিয়োগীও। তিনি বলেন, ‘‘নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। আসলে পঞ্চায়েত এলাকা হওয়ায় সাফাই কর্মীর অভাব রয়েছে। পথবাতির বিষয়ে পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলব।’’

kashiwar odisha king subarnarekha history
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy