পুরনো রেসিপি মেনেই আজও রান্না হয় শহরের এই সাবেক হোটেলে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
সময়টা ১৯৬৭-৬৮ হবে। ঝাড়গ্রামে জনসভা সেরে গাড়ি চেপে ফিরছিলেন তত্কালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। পথে গাড়িতে বসেই ‘ইউনিক’ রেস্তোঁরার কষা মাংস দিয়ে রুটি চেটেপুটে খেয়ে তারিফ করেছিলেন। কিন্তু ঝাড়গ্রামের প্রথম পুরোদস্তুর রেস্তোঁরা ‘ইউনিক’, আজ ইতিহাস।
ঝাড়গ্রামে প্রথম আফগানি কাটলেটের আমদানি হয়েছিল শহরের মেন রোডের ধারে অশোকা রেস্তোঁরার হাত ধরে। সত্তরের দশকে ‘বাঘবন্দী খেলা’র ছবির শ্যুটিংয়ে এসে বেশ কয়েক দিন ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির অতিথিশালায় ছিলেন উত্তমকুমার। বিকেলে মহানায়কের জন্য এই হোটেলেরই কাটলেট নিয়ে যেতেন শ্যুটিং ইউনিটের কলাকুশলীরা।
সেই সময় এই অরণ্যশহর ছিল পঞ্চায়েত এলাকা। হাঁদুবাবুর দোকানের দোতলায় সার সার টেবিল জুড়ে জমে উঠত আড্ডা। ঝাড়গ্রামবাসীর মধ্যে রেস্তোঁরার প্রথম ধারণা গড়ে উঠেছিল সাদামাঠা মিষ্টির আঙিনাতেই। সময়ের হাত ধরে অরণ্যশহরের বদলের তালিকায় রয়েছে শহরের নানা পুরনো রেস্তোঁরা। এর মধ্যে অনেক রেস্তোঁরার অবশিষ্ট আর কিছুই নেই, কোথাও বা নতুনদের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ধঁুকছে রসনার পুরনো সেই নিদর্শনগুলো। আবার কোথাও বা নতুনদের যথারীতি পাল্লা দিচ্ছে পুরনো সেই সব হোটেল।
যেমন, ঝাড়গ্রামের প্রথম পুরোদস্তুর রেস্তোঁরা ‘ইউনিক’ আজ ইতিহাস। ষাটের দশকের শেষের দিকে জুবিলি বাজার লাগোয়া মেন রোডের ধারে রেস্তোঁরাটি চালু করেছিলেন রঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী। অরণ্যশহরের প্রবীণদের মনে রসনার স্মৃতি জাগিয়ে তোলা এই রেস্তোঁরাতেই প্রথম কাটলেট ও মোগলাই পরোটা তৈরি হয়। এখানকার কষা মাংসেরও সুখ্যাতি ছিল। লাল মশলার চাদরে মোড়া তুলতুলে নরম মাংস দিয়ে রুটি খাওয়ার জন্য বাড়ির পাত ছেড়ে হাজির হতেন অনেকেই। অরণ্যশহরের প্রবীণ নাগরিক তথা ঝাড়গ্রামের প্রাক্তন বিধায়ক অবনীভূষণ সত্পথী জানান, খোদ জ্যোতি বসুও ইউনিকের কষা মাংসে মজেছিলেন। সত্তরের দশকের গোড়ায় এই রেস্তোঁরার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। এখন সেই রেস্তোঁরার জায়গায় রয়েছে সাইকেলের দোকান।
১৯৭৩ সাল নাগাদ মেন রোডের ধারে অশোকা নামের রেস্তোঁরাটি চালু করেন স্থানীয় বাসিন্দা প্রয়াত দীনেশচন্দ্র কুণ্ডু ও তাঁর বন্ধু বীরেন্দ্রনাথ সিংহ। বর্তমানে ঝাড়গ্রামের চালু রেস্তোঁরাগুলির মধ্যে এটিই সবচেয়ে পুরনো। রেস্তোঁরাটির বর্তমান মালিক মৃন্ময় কুণ্ডু জানান, ঝাড়গ্রামে তাঁদের দোকানই প্রথম পরিবেশন করেছিল আফগানি কাটলেট। ঘন গ্রেভির মধ্যে মুচমুচে কিমাদার আফগানির টানে এখনও অনেকেই নিয়মিত আসেন। তিনিই জানান, ‘বাঘবন্দি খেলা’র শ্যুটিংয়ে এসে উত্তমকুমারের জন্য এখান থেকে কাটলেট নিয়ে যাওয়ার গল্প। মৃন্ময়বাবু বলেন, “বাবার সময়কার রেসিপি মেনেই বিভিন্ন ধরনের কাটলেট, মোগলাই পরোটা ও কষা মাংসও আজও তৈরি হচ্ছে।”
আশির দশকে স্টেশন রোডের ‘রংমহল’ রেস্তোঁরাটি প্রথম তন্দুরি-খানা চালু করেছিল। নব্বইয়ের দশকে চাইনিজের জন্য কলেজ মোড়ের ওয়েসিস রেস্তোঁরাটিও জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে দু’টি রেস্তোঁরাই বন্ধ হয়ে যায়। বছর চোদ্দ আগে মেন রোডে ‘ডলফিন’ রেস্তোঁরাটিরও বেশ নাম ডাক হয়েছিল। সেটিও এখন বন্ধ। মেন রোডের ধারে মল্লিক নিরামিষ মিষ্টি ও সিঙাড়ার তালিকায় একদিন একটি আমিষ খাবারের আমদানি হল। আলু, পেঁয়াজ ও বিট-গাজরের মিশেলে তৈরি ভেজিটেবল চপে মজল শহর ঝাড়গ্রাম!
১৯৮২ সালে ঝাড়গ্রাম পুর-এলাকা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই দ্রুত বদলাতে থাকে অরণ্যশহর। এখন শহরের জনসংখ্যা পঁয়ষট্টি হাজারের কাছাকাছি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নতুন নতুন অনেক রেস্তোঁরাও। কিন্তু শহরবাসীর আক্ষেপ, রেস্তোঁরার সংখ্যা বাড়লেও খুব ভাল মানের রেস্তোঁরার সংখ্যা একেবারেই নেই বললেই হয়। অরণ্যশহরের বাসিন্দা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ চিন্ময় সেনগুপ্ত, চিকিত্সক প্রসূন ঘোষ, ব্যবসায়ী সায়ন্তন রায়, শিক্ষিকা অর্পিতা পালের বক্তব্য, “সেরকম ভাল রেস্তোঁরা আর কোথায়! শহরে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের কোনও রেস্তোঁরা নেই। ধোসা ইডলি খেতে হলে রাস্তার ঠেলাগাড়িই ভরসা। খাস চাইনিজ রেস্তোঁরাও নেই।”
বর্তমানে যে সব রেস্তোঁরা রয়েছে, সেগুলিতে দিনের বেলা ডাল-ভাত পাওয়া যায়। শহরের বানজারা গার্ডেন রেস্টুরেন্টের মালিক বিপ্লব ঘোষের কথায়, “দিনের বেলা মহকুমা সদরে বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রচুর বাইরের লোকজন আসেন। ফলে দুপুরে ভাত-ডাল-মাছের ঝোলের চাহিদা বেশি। বিকেলে আবার পুরোদস্তুর রেস্তোঁরার আইটেম মেলে।” রবীন্দ্রপার্কের ভিতরে ‘ও-টু’ গার্ডেন রেস্টুরেন্ট, ঘোড়াধরা পাওয়ার হাউস রোডের ‘সোনার তরী’র মতো অনেক নতুন রেস্তোঁরা চালু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রঘুনাথপুর সেটেলমেন্ট মোড়ের কাছে ‘হট লিপস্’-এর খাবার নিয়ে ভোজন রসিকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। এখানকার মশলা জারিত ভেটকির চওড়া ফিলে দিয়ে তৈরি ‘ফিস পকেট’ ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। তবে, গুণগত মানের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে পুরনো ঝাড়গ্রামের গ্রিনপার্ক ফ্যামিলি রেস্টুর্যান্ট। ওই রেস্তোঁরার মালিক, রাজ পরিবারের উত্তরসূরী জয়দীপ মল্লদেবের দাবি, “একমাত্র আমাদের রেস্তোঁরায় বাতানুকুল ব্যবস্থা রয়েছে। তন্দুরি, মোগলাই, চাইনিজ-সহ ১১৫ রকম খাবারের পদ বানাই আমরা।” শহরের চিকিত্সক প্রসূন ঘোষ বলেন, “গ্রিনপার্কের খাবার-দাবার নিঃসন্দেহে খুবই ভাল। তবে লাগোয়া একটি পানশালা থাকায় অনেকেই পরিবার নিয়ে যেতে সঙ্কোচ বোধ করেন।”
কিন্তু কেন এই শহরে ভাল রেস্তোঁরা কম? এর জন্য অবশ্য বিগত কয়েক বছরের মাওবাদী সন্ত্রাস পর্বকেই দায়ী করেছেন রেস্তোঁরা মালিকদের একাংশ। পাশাপাশি, ভারি শিল্প বিহীন এই শহরের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিও কিছুটা দায়ী। এখনও তাই কম খরচে ঠেলা গাড়ি ও ফুটপাতের ধারে খাবার দোকানগুলিতে মজে রয়েছেন পুরবাসীর একাংশ। এই আবহে, রেস্তোঁরাগুলি সাজানোর ঝঁুকি নিতে চান না মালিকরা।
এই শহরে ঠেলা গাড়ি কতটা জনপ্রিয় তার প্রমাণ বংশী রাউত নিজেই। সত্তরোর্ধ্ব বংশীবাবু গত তিরিশ বছর ধরে ঠেলাগাড়িতে ঘুগনি ও বারোভাজা বিক্রি করছেন। রাজ কলেজের কাছে তিনি যেখানে রোজ ঘুগনি বেচেন, সেই রাস্তার মোড়টিই শহরবাসীর কাছে বংশীর মোড় নামে পরিচিত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy