পরিত্যক্ত মহিষাদলের রাজ হাই স্কুল। ছবি:আরিফ ইকবাল খান।
তাম্রলিপ্ত বন্দরে যখন রমরমিয়ে বাণিজ্য চলছে তখনও মহিষাদল সমুদ্রগর্ভে। খ্রিষ্ট্রিয় সপ্তম শতক অবধিও মহিষাদলে কোনও জনপদ গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে পলি পড়ে চর, জঙ্গল তৈরি হয়। তারপরই এখানে বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। আর জনপদের খ্যাতি বাড়ে মহিষাদল রাজ পরিবারের হাত ধরে। এক সময় জঙ্গল ঘেরা জনপদ আজ মহিষাদল ব্লকের সদর এলাকা। পূর্ব মেদিনীপুরের এই এলাকা পুরসভার দাবিদারও বটে।
মহিষাদলের নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিক সত্যতা না থাকলেও বহু জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ বলেন, জনপদের আকার মহিষের আদলের মত ছিল। তাই নাম মহিষাদল হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে বসতি গড়ে ওঠার প্রথম দিকে মাহিষ্য জাতির আধিক্য ছিল। তাই এই এলাকার নাম মহিষাদল। কারও মতে এখানে বহু মহিষ বিচরণ করত, তাই এমন নাম। তবে যে ভাবেই মহিষাদল নামটি আসুক না কেন, ওই নামে এই ব্লক এলাকায় কোনও মৌজা বা জায়গা নেই। এলাকার কয়েক’টি মৌজাকে নিয়ে ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় মহিষাদলের পত্তন হয়।
এলাকার বাসিন্দা তথা মহিষাদল রাজ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক হরিপদ মাইতি জানান, মহিষাদলে দুটি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। জেলার একমাত্র মহিলা কলেজও এখানেই রয়েছে। চারটি উচ্চমাধ্যমিক ও দুটি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ব্লক সদর হলেও এখানকার পরিকাঠামোর বিস্তর খামতি রয়েছে। নিকাশির ব্যবস্থা নেই। ফলে বৃষ্টি হলেই মহিষাদলের বিভিন্ন এলাকায় জল জমে যায়। মহিষাদল থেকে তমলুকগামী রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা থাকলেও মহিষাদল বাজারের ভেতরে আলোর তেমন ব্যবস্থা নেই। বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছানোর ব্যবস্থাও নেই। নেই ময়লা আবর্জনা ফেলার ভ্যাট। অথচ প্রতি বছরই হুহু করে ঘর বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই তা তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ। এলাকাবাসী তাই বহু দিন ধরেই পুরসভার দাবি জানাচ্ছেন।
ইতিমধ্যেই অবশ্য মহিষাদলের বিডিও এই ব্লক সদরকে পুরসভায় উত্তীর্ণ করার জন্য লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের কাছে। মহিষাদল ব্লক সদর লাগোয়া পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩টি মৌজাকে নিয়ে পুরসভা গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত এলাকার ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ২৭ হাজার ৯৮১ জন বসবাস করেন। এলাকার ৭০ শতাংশ মানুষ অ-কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। এমনই নানা তথ্য দিয়ে ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহিষাদলকে পুরসভা উত্তীর্ণ করার জন্য দরবার করা হয়েছে।
মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি তিলক চক্রবর্তী বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে যতটা উন্নয়ন করা সম্ভব আমরা করছি। আমরা আশাবাদী সরকার মহিষাদলকে পুরসভা হিসাবে স্বীকৃতি দেবে।” এমনটা বাস্তবায়িত হলে এলাকার পরিকাঠামো গত আরও উন্নয়ন হবে বলে তাঁর আশা।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিষাদলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরাধীন ভারতে স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশ সামন্তের বাড়ি এই মহিষাদলেরই একটি গ্রামে। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অপর কর্মকর্তা সুশীল ধাড়ার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে রয়েছে মহিষাদলে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু ঘটনার সাক্ষী এই মহিষাদল।
এলাকার বাসিন্দা হরপ্রসাদ সাহু মহিষাদলের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। তাঁর কথায়, গোটা এলাকা এক সময় বঙ্গোপসাগরের গর্ভে ছিল। পরে পলি জমে চর ও জঙ্গল তৈরি হয়। জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে ওঠে। সপ্তম শতকের শুরুতে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ তাম্পলিপ্ত বন্দরে এসেছিলেন। তাঁর বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়, এখনকার মহিষাদল সমুদ্রগর্ভে ছিল।
মহিষাদল রাজ পরিবারের সদস্য শঙ্করপ্রসাদ গর্গ জানান, রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জনার্দন উপাধ্যায়। মোগল সম্রাট আকবরের অধীন সেনাবাহিনীর উচ্চপদে কাজ করতেন তিনি। ষষ্ঠদশ শতকে উত্তরপ্রদেশ থেকে জনার্দন উপাধ্যায় ব্যবসার জন্য নদীপথে মহিষাদলের উপকণ্ঠে গেঁওখালিতে আসেন। সে সময় এলাকার রাজা ছিলেন কল্যাণ রায়চৌধুরী। রাজধানী ছিল গড়গুমাই। কল্যাণ রায়চৌধুরির থেকে মহিষাদলের স্বত্ব কিনে তিনি নতুন রাজা হন। রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর রানী জানকী রাজত্বের দায়িত্ব নেন। এরপর তার জামাতা ছক্কনপ্রসাদ গর্গের ছেলে গুরুপ্রসাদ গর্গ রাজা হন। সেই থেকে মহিষাদলে গর্গদের রাজত্ব।
এখন পুরানো নিদর্শন বলতে মহিষাদলে রাজাদের দু’টি রাজবাড়ি রয়েছে। একটি হচ্ছে রঙ্গিবসান রাজবাড়ি। যা আনুমানিক ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয়েছিল। অন্যটি ফুলবাগ রাজবাড়ি যা আনুমানিক ১৯৩৪ সালে তৈরি হয়। তা ছাড়াও রাজবাড়ি চত্বরে গোপাল জিউর মন্দির ও রামবাগে রামজীউর মন্দির রয়েছে। রঙ্গিবসান রাজবাড়িতে এখনও রাজ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকজন বসবাস করেন। তবে অপেক্ষাকৃত নতুন রাজবাড়িটির দোতলায় এখনও রাজ পরিবারের সদস্যেরা বসবাস করেন। নীচের তলায় রয়েছে সংগ্রহশালা।
মহিষাদলের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক সংকর্ষণ মাইতি জানান, রাজারা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে প্রজাদের উৎসাহ দিতেন। মহিষাদল রাজ কলেজ থেকে শুরু করে রাজ হাইস্কুল-সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন তাঁরা। শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে উন্নয়ন— সব কিছুতেই মহিষাদল রাজবাড়ি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy