নায়ক ভোটারের ছবি তুলতে ব্যস্ত বুথরক্ষীও। সোমবার দক্ষিণ কলকাতার একটি ভোটকেন্দ্রে দেব। ছবি: সুব্রতকুমার মণ্ডল
দুধসাদা টাটা আরিয়া সবে কুশপাতা তৃণমূল পার্টি অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বেলা ১১টার চাঁদিফাটা রোদের তোয়াক্কা না-করা মেয়েদের জমাট ভিড় থেকে সমস্বরে একটা আঁ-আঁ-আঁ-আঁ চিৎকার উঠল।
তার পরেই ঝঞ্ঝাপাত! স্টেনগানধারী রক্ষীদের ছত্রখান করে অন্তত আটজোড়া শাঁখা-পলা পরা হাত দশদিক থেকে দীপক অধিকারী, ওরফে দেবের হাত খিমচে ধরেছে। “ও বৌদি টানবেন না, টানবেন না, পড়ে যাবে যে!” আর্তনাদ করছেন তৃণমূলের নেতারা। এক মেজো নেতা দাবড়ালেন, “কী হচ্ছে? এটা দলের অফিস। আজ ভোট। সিনেমা হচ্ছে নাকি? সরে যান বলছি।” উল্টে এক বৌদির হুঙ্কার, “এখনও ভোটটা দিইনি মনে রাখবেন। বার করে দিয়ে দেখুন না কী হয়।” নিমেষে মিইয়ে গেলেন নেতা। বৌদি নায়কের দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়লেন। নায়ক ভ্যাবাচ্যাকা, বৌদির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
সোমবার নিজের ভোটের লড়াইয়ের এলাকায় এই ছিল দীপক অধিকারীর প্রথম অভিজ্ঞতা। তার পর যে বুথেই গিয়েছেন, বয়স নির্বিশেষে মহিলারা তাঁর পিছু ছাড়েননি। জিনস, কালো টি শার্ট, বাঁ-কানে প্ল্যাটিনামের দুল, দেবও অকাতরে হাসি বিলিয়ে গিয়েছেন। তবে ভেতরে-ভেতরে যে একটা থরথরানি হচ্ছে, স্বীকার করলেন। “আমার এটা ফার্স্ট টাইম তো। ম্যাসিভ টেনশন হচ্ছে।” উদ্বেগ কাটাতে রবিবার সন্ধ্যায় চুলে নতুন ছাঁট দিয়েছেন। দুই জুলপির উপরের দিকে সমান্তরাল দু’টো জায়গা অল্প চেঁছে দেওয়া, এটা নাকি ‘দেব কাট।’ মুখে ‘অ্যান্টি-ট্যান ট্রিটমেন্ট’ হয়েছে। রোদে পুড়ে বড্ড কালো হয়েছিলেন। এর পরেও রাতে ঘুমোতে পারেননি, সকালে উঠে খেতেও ইচ্ছে করেনি। সাড়ে ৭টা নাগাদ নিজের ভোটটা দিয়ে সোজা রওনা দেন ঘাটাল।
ও দিকে তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রও ছিল কিছুটা সংশয়ে। দেব সত্যিই আসবেন তো? এলেও বুথে-বুথে ঘুরবেন তো? শেষ পর্যন্ত নায়কের আবির্ভাবে সে সব মেঘ উধাও। ভক্তদের ভালবাসার অত্যাচার সামলানোর এক ফাঁকে দেব বললেন, “ঘাটালে আজ কোনও ঝামেলা হয় কি না তার দিকে সবার নজর থাকবে। এমনিতেই সেনসিটিভ জায়গা।” সাংবাদিকেরা জানালেন, দাসপুর ১-এর রাজনগর এলাকায় কিছু বুথে তৃণমূল অনেককে ভোট দিতে দিচ্ছে না। শুনে প্রার্থীর মন্তব্য, “আমি কিন্তু কখনও বলিনি আমাকে ভোট দাও। বলেছি, ‘ভোট ফর ইওর কান্ট্রি।’ ভোট দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, কাকে দিচ্ছো সেটা নয়।” আর কিছু বলার আগেই বাদ সাধলেন তৃণমূলের কিছু নেতা। “হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। এ বার বন্ধ করুন।”
ততক্ষণে পার্টি অফিসের দরজা ধাক্কানো চলছে, সঙ্গে চিৎকার “গুরু একটু দেখা দাও।” অগত্যা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক প্রস্ত হাত নাড়লেন। তার পর ভিড়ে ভেসেই ফের গাড়িতে। গন্তব্য দেবভিলা। সেখানে মধ্যাহ্নভোজ আর বিশ্রামের ব্যবস্থা। রুটি, মুগের ডাল, আলু পোস্ত, মুরগির মাংস আর টক দই। খেয়েদেয়ে পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করতে আধঘণ্টার একটা বৈঠক। কনভয় রওনা দিল পৌনে দু’টো নাগাদ। ঘাটালের কিছু বুথ, কেশপুর, ডেবরা, সবং হয়ে কলকাতা।
ঘাটালের রাধারানি সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়। গরমে প্রায় ফাঁকা বুথে বাচ্চা কোলে কয়েক জন দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেবকে দেখে প্রথমে বাক্যিহারা, তার পরেই, “ও মনি, দেখে যা দেব এসেছে দেব এসেছে!” পোলিং অফিসারেরা বিগলিত মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন। প্রার্থী খোঁজ নিচ্ছেন, কেমন ভোট হচ্ছে। ৮৫% ভোট পড়েছে শুনে খুশি-খুশি মুখে সাংবাদিকদের বললেন, “দেখেছেন, কী দারুন পোল হচ্ছে।” সেখান থেকে একে-একে রসিকগঞ্জ বিদ্যালয়, দাসপুর বিবেকানন্দ হাইস্কুল, বেলিয়াঘাটা হয়ে কেশপুরের রাস্তায়। সর্বত্র একই ছবি। যেখানেই যাচ্ছেন, মানুষ দৌড়চ্ছে পিলপিল করে।
ছেলেকে ঘাড়ে চড়িয়ে দেব দেখাচ্ছেন বাবা। মনে হল, গাড়িতে ওঠার আগে সে দিকে তাকিয়েই হেসে হাত নাড়লেন নায়ক-প্রার্থী। ছেলে দুলে-দুলে গাইছে“লে পাগলু ডান্স,ডান্স, ডান্স, ডান্স, ডান্স, ডান্স!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy