Advertisement
E-Paper

ক্রমশ বাড়ছে চড়া, বিপন্ন দিঘার মোহনা

দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি তোলপাড় করে মাছ ধরে সৈকতে ফেরা। মাছ শিকারের পর মাছ বিক্রি, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে দিঘা-সহ সংলগ্ন এলাকার আর্থিক বুনিয়াদ। দিঘায় এখন দেড় হাজার ট্রলার ছাড়াও আড়াইশোরও বেশি ভুটভুটিতে মৎস্যজীবীরা সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করেন। পেটুয়া, জুনপুট, শৌলা, শঙ্করপুর, জলধা, নিউ জলধা এমনকী ওড়িশা উপকূলের প্রায় ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক মাছ দিঘা মোহনার বাজারে বিক্রির জন্য আসে।

সুব্রত গুহ

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৩
দিঘা মোহনার এই চড়া ঘিরেই চিন্তায় মৎস্যজীবীরা। —নিজস্ব চিত্র।

দিঘা মোহনার এই চড়া ঘিরেই চিন্তায় মৎস্যজীবীরা। —নিজস্ব চিত্র।

দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি তোলপাড় করে মাছ ধরে সৈকতে ফেরা। মাছ শিকারের পর মাছ বিক্রি, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে দিঘা-সহ সংলগ্ন এলাকার আর্থিক বুনিয়াদ।

দিঘায় এখন দেড় হাজার ট্রলার ছাড়াও আড়াইশোরও বেশি ভুটভুটিতে মৎস্যজীবীরা সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করেন। পেটুয়া, জুনপুট, শৌলা, শঙ্করপুর, জলধা, নিউ জলধা এমনকী ওড়িশা উপকূলের প্রায় ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক মাছ দিঘা মোহনার বাজারে বিক্রির জন্য আসে। দিঘা ফিশারমেন অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব শ্যামসুন্দর দাশের কথায়, “বছরের ন’মাস প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ মোহনায় বিক্রি হয়। যার বাজার মূল্য আড়াই থেকে তিন কোটিরও বেশি। বিক্রি হওয়া মাছের আবার ৮০ শতাংশ বিদেশে রফতানি হয়।”

এমন বিপুল কর্মযজ্ঞে প্রায় তিরিশ হাজার মৎস্য ব্যবসায়ী প্রত্যক্ষ ভাবে এবং মাছ প্রক্রিয়াকরণ, মাছ শুকনো করা, জাল তৈরি-সহ নানা কাজে কয়েক লক্ষ মানুষ পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। এ ছাড়াও রয়েছে নৌকা তৈরি ও মেরামত, মাছের ঝুড়ি, চট, দড়ি, প্লাস্টিকের প্যাকিং তৈরি থেকে বরফকল, রিকশা, ভ্যান-সহ পরিবহণের কাজে যুক্ত লোকেরা। দিঘা মোহনায় এই কমর্কাণ্ডকে কেন্দ্র করে নানা দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বাজার গড়ে উঠেছে।

অথচ মজার ব্যাপার হল, ষাটের দশকের আগে সমুদ্রে মাছ শিকার ও তা বিক্রির ব্যাপারে কোনও ধারনা ছিল না এখানকার মৎস্যজীবীদের। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিশেষ করে করে রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, লালগোলা এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের লোকেরা দিঘা ও তার আশেপাশের সমুদ্রপাড়ে অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করেন। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করাই ছিল তাঁদের কাজ। সেই কাজ দেখে উৎসাহিত হয়ে স্থানীয়য়েরাও ক্রমশ এই পেশার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন।

সামুদ্রিক মাছ শিকার নিয়ে কোনও সরকারি বিধি না থাকায় সমুদ্রে জাল ফেলা, মাছ শিকার নিয়ে বিভিন্ন এলাকার মৎস্যজীবীদের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব হত। সেই গোলমাল মেটাতে এবং মৎস্যজীবীরা যাতে ন্যায্য দামে মাছ বিক্রি করতে পারেন সে জন্য মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় কিছু শুভানুধ্যায়ীর চেষ্টায় তৈরি হয় ‘দিঘা ফিশারমেন অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন’। মৎস্যজীবী এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন হিসেবে ১৯৭৫ সালে সরকারি স্বীকৃতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। সে দিনের সংগঠনটি আজ মহীরূহ। প্রতিষ্ঠানটি আজও নানা সামাজিক কাজে সক্রিয়।

সমুদ্রের চড়া পড়তে শুরু করা মৎস্যজীবীদের বর্তমান সঙ্কটগুলির অন্যতম প্রধান। ২০০৪ সালে মৎস্য দফতরের পক্ষ থেকে খাঁড়িতে ড্রেজিং ও কেন্দ্রীয় সরকারের জলসম্পদ ও শক্তি দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন পুনের ওয়াটার পাওয়ার রিসার্চ সেন্টারের ব্যবস্থায় ‘গ্রোয়েন’ পদ্ধতিতে সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত ৫০০ মিটার চওড়া কংক্রিটের পাঁচিল তৈরি করা হয়। তাতে সমুদ্র ভাঙন কিছুটা ঠেকানো গেলেও দিঘা সৈকতের পশ্চিমে ওড়িশার তালসারির কাছে বঙ্গোপসাগরে সূবর্ণরেখা নদীর মোহনায় বালুচর তৈরি হয়ে তা ক্রমশ বেড়ে নিউ দিঘার দিকে এগিয়ে আসছে। জোয়ারের জলের স্রোত পশ্চিম দিক থেকে পূবের দিকে সরছে। তার জেরে দিঘা মোহনা ও শঙ্করপুর খালে বালি জমে নাব্যতা কমে চড়া পড়েছে।

একে সমুদ্রে মাছ কমছে, তার উপরে চড়া বাড়তে থাকায় আমাদের জাত ব্যবসাই তো সঙ্কটে, বলছেন স্থানীয় মৎস্যজীবী তপন মাইতি, প্রদীপ রায়েরা। ট্রলার চালক মুকুল জানা, বিকাশ পাত্রেরা বলছেন, সমুদ্র সৈকত ধরে পুবদিকে দু’কিলোমিটার হাঁটলেই পড়ে দিঘা মোহনা। রামনগর খাল বা শঙ্করপুর খাল এখানেই সমুদ্রে মিশেছে। এই মোহনাও চড়ার কবলে। ফলে সমুদ্র থেকে মাছভর্তি জাহাজ ভাটার সময়ে মোহনায় ঢুকতেও সঙ্কটে পড়ে।

২০১২ সালে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে চড়া সংস্কার করে নাব্যতা বাড়াতে উদ্যোগী হয় মৎস্য দফতর। মোহনার মৎস্যজীবীদের অবশ্য অভিযোগ, সমুদ্র বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোর জন্য যে ধরনের উন্নতমানের ড্রেজার ব্যবহার করা হয়, তা না করে জেসিপি মেসিন দিয়ে খাঁড়ির মাটি তোলা হয়। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

দিঘা ফিশারমেন অ্যান্ড ফিশ ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রণবকুমার কর, শ্যামসুন্দরবাবু সহ মোহনার মৎস্যজীবীদের দাবি, অবিলম্বে উপযুক্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে খাঁড়ির চড়া ড্রেজিং না করানো হলে দিঘা মোহনার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে মৎস্য ব্যবসায়ীদের জীবনজীবিকাও। এমন সঙ্কটে কী বলছে রাজ্য মৎস্য দফতর?

পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, “মোহনার ড্রেজিং এবং গ্রোয়েন বাঁধ মেরামতির জন্য ১৫ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তার ভিত্তিতে টেন্ডারও ডাকা হয়েছে।” এখন দেখার, কাজ কবে শুরু হয়। সে দিকেই চেয়ে মৎস্যজীবীরা।

digha amar sohor amar shohor subrata guha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy