Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নিরাপত্তায় মোড়া জঙ্গলমহলে শান্তির ভোট

কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে ‘শান্তির ভোট’ দেখল জঙ্গলমহল! দিনের শেষে ঝাড়গ্রাম লোকসভায় ভোট পড়ল ৮৭ শতাংশ। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের থেকে ভোটের হার বেড়েছে প্রায় দশ শতাংশ। বুধবার ভোট চলাকালীন মেদিনীপুর কেন্দ্রের কেশিয়াড়ি ও নারায়ণগড়ের থেকে একেবারে ভিন্ন ছবি দেখা গেল ঝাড়গ্রামের বুথগুলিতে। তবে এই কেন্দ্রের গড়বেতা, শালবনি ও গোপীবল্লভপুর বিধানসভা এলাকার বেশ কিছু বুথে তৃণমূল ‘ভোট লুঠ’ করেছে বলে নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানিয়েছে সিপিএম।

বেলপাহাড়ি কাঁকড়াঝোড় রাস্তায় কড়া নিরাপত্তা।—নিজস্ব চিত্র।

বেলপাহাড়ি কাঁকড়াঝোড় রাস্তায় কড়া নিরাপত্তা।—নিজস্ব চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত ও অভিজিৎ তক্রবর্তী
লালগড় ও গড়বেতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০১:৫৪
Share: Save:

কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে ‘শান্তির ভোট’ দেখল জঙ্গলমহল! দিনের শেষে ঝাড়গ্রাম লোকসভায় ভোট পড়ল ৮৭ শতাংশ। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের থেকে ভোটের হার বেড়েছে প্রায় দশ শতাংশ। বুধবার ভোট চলাকালীন মেদিনীপুর কেন্দ্রের কেশিয়াড়ি ও নারায়ণগড়ের থেকে একেবারে ভিন্ন ছবি দেখা গেল ঝাড়গ্রামের বুথগুলিতে। তবে এই কেন্দ্রের গড়বেতা, শালবনি ও গোপীবল্লভপুর বিধানসভা এলাকার বেশ কিছু বুথে তৃণমূল ‘ভোট লুঠ’ করেছে বলে নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানিয়েছে সিপিএম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জঙ্গলমহলে সংগঠনিক ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর দাবি করেছিল বামেরা। তবে এ দিন জঙ্গলমহলের বেশ কিছু বুথে বামেরা নির্বাচনী এজেন্টই দিতে পারে নি। শান্তি ও উন্নয়নের প্রশ্নে পঞ্চায়েত ও পুরভোটের পরে এবার লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলে বৃত্ত সম্পূর্ণ করার ডাক দিয়েছিল শাসক দল। এ দিন ভোটদানের হার দেখে তাই বিরোধীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

ভোট শুরুর আগে থেকেই বুথে বুথে ছিল লম্বা লাইন। মাওবাদী-জনগণের কমিটির একদা ঘাঁটি লালগড় এবং বেলপাহাড়িতে ভোটদানের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। লালগড়ের রামগড় এলাকার মোক্ষদা সুন্দরী হাইস্কুলের দু’টি বুথেই ছিল দীর্ঘ লাইন। মহিলারা ছিলেন সংখ্যায় বেশি। গোটা বুথ ঘিরে রেখেছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। দু’টি বুথেই কংগ্রেস, তৃণমূল ও সিপিএমের এজেন্টরা ছিলেন। লালগড়ের নাড়চ্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন লক্ষ্মীমণি টুডু। যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত জনগণের কমিটির সভাপতি লালমোহন টুডুর স্ত্রী লক্ষ্মীমণিদেবী বলেন, “এলাকায় শান্তি ও উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে আমরা সবাই-ই ভোট দিচ্ছি।” নাড়চ্যা বুথে কেবলমাত্র তৃণমূলের এজেন্ট ছিলেন। তবে উল্টো ছবিও দেখা গেল বীরকাঁড় প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথে। সেখানে সিপিএম ও তৃণমূল দুই দলের এজেন্টই ছিলেন। ওই বুথে তৃণমূল এজেন্ট ছিলেন কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধরের কাকা হারাধন মাহাতো। ছত্রধরের বাবা, মা ও স্ত্রী অবশ্য ভোট দেননি।

ভোটের লাইনে জনগণের কমিটির নিহত নেতা লালমোহন টুডুর স্ত্রী লক্ষ্মীমণি (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)।—নিজস্ব চিত্র।

লালগড়ের নেতাই গ্রামের দু’টি বুথে কেবলমাত্র শাসকদলের এজেন্টরা ছিলেন। গ্রামে ঢোকার মুখে দেখা হল লালগড় ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি তন্ময় রায়ের সঙ্গে। মোটর বাইক দাবড়ে যাওয়ার আগে তন্ময় বললেন, “জঙ্গলমহলের শান্তি ও উন্নয়নের জন্যই মানুষ একতরফা আমাদেরই সমর্থন করছেন। দেখুন কী শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে!” নেতাই গ্রামের দু’টি বুথে দুপুরের মধ্যে ৮৫ শতাংশ ভোট পড়ে যায়। লালগড়ের ধরমপুর স্টেট প্ল্যান প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথে ভোট দিতে আসেন নেতাই-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত সদ্য ধৃত সিপিএম নেতা অনুজ পাণ্ডের মা, স্ত্রী ভাই। বুথের বাইরে মোটর বাইক নিয়ে হাজির জনগণের কমিটির প্রাক্তন নেতা বর্তমানে তৃণমূলের ধরমপুর অঞ্চল সভাপতি দিলীপ মাহাতো। দিলীপবাবু বলেন, “এক সময় অনুজবাবুরা এক তরফা ভোট করাতেন। আমরা কিন্তু ওদের পথে হাঁটিনি।” অনুজের খাসতালুকে তৃণমূলের পাশাপাশি, সিপিএমেরও বুথ এজেন্ট ছিল। অনুজের ভাই উজ্জ্বল অবশ্য ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে বলেন, “পরিবর্তন হয়েছে। এ বার প্রত্যাবর্তনও হবে।”

এ দিন বেলপাহাড়িতেও ভোট মিটেছে নির্বিঘ্নে। এক সময়ের মাওবাদী ধাত্রীভূমিতে সর্বত্রই স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হতে টহল দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। দুপুর আড়াইটে নাগাদ ঝাড়খণ্ড সীমান্ত লাগোয়া বেলপাহাড়ির ডাকাই গ্রামের বুথে গিয়ে দেখা গেল ৭৯০ জন ভোটারের মধ্যে ৬১০ জন ভোট দিয়েছেন। ভোট দিতে আসা ডাকু সিংহ, সুভদ্রা সিংহ-রা জানালেন, “আমরা নির্ভয়ে ভোট দিয়েছি।” এক সময় মাওবাদী হুমকিতে দুর্গম পাহাড়ি এই গ্রামে কপ্টারে করে ভোটকর্মীদের নিয়ে আসা হতো। এ বার বাসে করে এসেছেন ভোটকর্মীরা। তৃণমূল ও সিপিএমের বুথ এজেন্টরাও ছিলেন। সিপিএম কর্মী লক্ষ্মীকান্ত মানকি ও তৃণমূল কর্মী রবিন মুণ্ডারা একযোগে বললেন, “পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। নির্ভয়ে ভোট দিচ্ছেন।”

ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে গড়বেতা। এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় বেনাচাপড়া গ্রামের বুথে ভোট দেন সিপিএম বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ। ওই বুথেও কেন্দ্রীয় বাহিনী। চলছিল রুট মার্চ। সুশান্তবাবু বলেন, “আদালতের নির্দেশে ভোট দিতে পেরে আমি খুশি।” স্বচ্ছ ভোট হলে বাম প্রার্থীরা অবশ্যই জিতবেন বলে আশা প্রাক্তন মন্ত্রীর। গড়বেতার ফুলবেড়িয়া, বাগমারি, খড়কুশমা, ধোবাবেড়িয়া-এই এলাকাগুলিতেও ভোট শান্তিপূর্ণ। উল্লেখ্য এই এলাকাগুলিরই বাসিন্দা ছিলেন সিপিএমের দাপুটে নেতা তপন ঘোষ, সুকুর আলি-সহ অন্যান্য নেতৃত্ব। তবে গড়বেতা, গোয়ালতোড় ও চন্দ্রকোনা রোডের অধিকাংশ বুথেই সিপিএমের এজেন্ট ছিল না। মাওবাদী অধ্যুষিত গোয়ালতোড়ে সকাল থেকেই ভোটের বুথে লম্বা লাইন চোখে পড়েছে। এলাকার ১৪৫টি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন ছিল। এলাকায় রিগিংয়ের তেমন অভিযোগ ছিল না। বিক্ষিপ্ত অশান্তি হয়েছে নয়াগ্রামেও। কোথাও বিরোধী এজেন্টকে বুথে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ, কোথাও ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ। হাতে গোনা কয়েকটি বুথ বাদে সর্বত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীও চোখে পড়েছে। ভোট নিয়ে বড় কোনও অভিযোগ নেই সিপিএমেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abhijit chakraborty kingshuk gupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE