যা দু’চার বছরে হয়নি তা হয়ে গেল পাঁচ মাসে! ইচ্ছে থাকলে যে উপায় হয়, তা করে দেখালেন সরকারি দফতরের কর্মীরাই। জমি-বাড়ির মিউটেশন বা নামপত্তনের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটল পশ্চিম মেদিনীপুরে।
আগে যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল মিউটেশন করার জন্য বিএলআরও অফিসে যাতায়াত করতে করতে খান কয়েক চপ্পল ছিঁড়বেই। তবু হবে কিনা সন্দেহ থাকত। কারণ, দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের ‘তুষ্ট’ না করলে নোটিস যেত না বলে অভিযোগ। তবে এ কাজে ১৫-২০ দিনের বেশি লাগার কথা নয়। জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক অরিন্দম দত্তের কথায়, “কিছু আধিকারিকের উদাসীনতা ছিল, এটা ঠিক। নাহলে এত দেরি হত না। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাতে হয়রান না হন সে জন্য আমরা প্রত্যেককে একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলাম। কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা নজরদারিও চালানো হয়েছিল। ফলে লক্ষ্যমাত্রা মেনে প্রত্যেকে কাজ করেছেন।”
ফল মিলেছে হাতেনাতে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও জেলায় নামপত্তনের আবেদনপত্র জমা ছিল ১ লক্ষ ২১ হাজার ৫৭৯টি। তারই সঙ্গে প্রতিদিনই নতুন নতুন আবেদনপত্রও পড়তে থাকে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেখা যায়, জমে থাকা আবেদনপত্রের পাহাড় কমেনি। এপ্রিল মাসে দেখা যায়, ওই পাহাড়ে আবেদনপত্রের সংখ্যা রয়েছে ১ লক্ষ ৪ হাজার ২৪৪টি। নতুন কিছু আবেদনপত্র জমা পড়লেও কাজ যে অতি ঢিমেতালে চলছে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। তারপরই জেলা থেকে শুরু হয় চাপ দেওয়া। সমানে চলতে থাকে নজরদারি। তাতে দেখা যায়, সুফল মিলছে। অগস্ট মাসেই জমির নামপত্তন হয়েছে ৫১ হাজার ২১৩টি! যে গড়বেতা-১, দাসপুর-২ ব্লকে ১০ হাজারের বেশি নামপত্তনের আবেদন জমা ছিল, সেখানে গড়বেতা-১ ব্লকে জমা থাকার সংখ্যা শূন্য। দাসপুর-২ ব্লকে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭২৫টিতে! গড়বেতা-৩, দাসপুর-১, কেশিয়াড়ি, দাঁতন-২ ব্লকগুলিতেও কোনও আবেদনপত্র পড়ে নেই। ফলে ওই সমস্ত এলাকার মানুষের হয়রানি অনক কমেছে। এই তদারকির ফলে জেলার ২৯টি ব্লকের মধ্যে বেশিরভাগ ব্লকেই পড়ে থাকা আবেদনপত্রের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০০ বা তারও নীচে। একমাত্র চন্দ্রকোনা-১ ব্লকে পড়ে রয়েছে ১১৩৪৮টি আবেদনপত্র। আর ৫ হাজারের কাছাকাছি আবেদনপত্র পড়ে রয়েছে ডেবরা ও সবং ব্লকে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর জানিয়েছে, ওই ব্লকগুলিতে অধিক আবেদনপত্র জমা থাকায় এখনও কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। তবে এবার ওখানে বিশেষ নজরদারি চালানো হবে।
কী ভাবে সমস্যার সমাধান হল?
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, যে সব ব্লকে রাজস্ব আধিকারিকের সংখ্যা কিছুটা কম ছিল সেখানে অন্য ব্লক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যে ব্লকে উপরি পাওনা না দিলে নামপত্তনের কাজ হত না সেখানে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ করা হত। প্রত্যেক রাজস্ব আধিকারিককে সপ্তাহে ন্যূনতম ২০০টি নামপত্তন করতেই হবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়। তা না করতে পারলে শনি ও রবিবারেও অফিস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে প্রতি মাসে একটি করে বৈঠক করা হত। তাতে দেখা গিয়েছে, শনি ও রবিবার অফিস করার ভয়ে এক এক জন রাজস্ব আধিকারিক সপ্তাহে ৩৭৯টি পর্যন্ত নামপত্তনের কাজ করেছেন! ২৯টি ব্লকের মধ্যে চারটি ব্লক বাদ দিলে প্রায় সব ব্লকেই নামপত্তনের পাহাড় সরে গিয়েছে। এক স্কুল শিক্ষকের কথায়, “ভাবতে পারবেন না, নামপত্তনের জন্য আমাকে মাসে গড়ে ২-৩ দিন স্কুল ছুটি নিতে হত শুধু তদ্বির করার জন্য। এভাবে এক বছর ঘুরতে হয়েছিল। তা নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে পর্যন্ত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এতদিনে স্বস্তি পেলাম। না হলে আদৌ কবে হত, কে জানে!”
আপাতত স্বস্তি পেলেও সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা, আগামী দিনেও এই পদ্ধতিই চলবে তো? নাকি ফের ফিরে আসবে আগের পুরনো পদ্ধতিই। আবার নামপত্তনের জন্য বছরের পর বছর হয়রান হতে হবে সাধারণ মানুষকে। সময়েই মিলবে জবাব।