শাসকদলের বদল হয়েছে। পাল্টেছে এলাকার শাসকের মুখ। তবু রাজনৈতিক হিংসার ইতিহাস এতটুকুও বদলায়নি সিপিএমের এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি কাঁথির সুনিয়ায়। রবিবার সুনিয়ায় ঘড়ছাড়া এক সিপিএম নেতার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের ঘটনা, সেই অভিযোগকেই ফের সামনে আনল।
পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির দেশপ্রাণ ব্লকের আমতলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সমুদ্র তীরবর্তী রসুলপুর নদীর তীরে সুনিয়ায় চরের জমি, বাগদা মাছের ভেড়ির দখল নিয়ে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক লড়াই নতুন নয়। এক সময় চরের জমির দখল নিয়ে আন্দোলনের জেরে সিপিআই-এর শক্তঘাঁটি ছিল সুনিয়া ও সন্নিহিত এলাকা। কিন্তু সিপিআই-এর অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও দীর্ঘ দিন রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় থাকা বাম আমলে এই সুনিয়ার চরের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সিপিএমের হাতে।
এর জেরেই বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের মারধর, জোর করে জমির দখল থেকে ঘরবাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় সিপিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রোজকার ঘটনা। সে সময়ে এলাকায় দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন আশিস গিরি। সিপিএমের জোনাল কমিটির এই সদস্য ২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশপ্রাণ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও ছিলেন তিনি। পরিবর্তনের পরে এখন অবশ্য তাঁরই সঙ্গে ঘরছাড়া রয়েছেন বেশ কিছু সিপিএম ও সিপিআই নেতা-কর্মী।
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম কাণ্ডের আগে পর্যন্ত খেজুরির মত কাঁথির এই এলাকাতেও একচ্ছত্র দাপট ছিল সিপিএমের। তখন সুনিয়া থেকে রসুলপুর নদী পেরিয়ে ঠিক উল্টো দিকে থাকা দলের শক্তঘাঁটি খেজুরিতে নিয়মিত আসত সিপিএমের বাহিনী। পরে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলায় রাজনৈতিক ভাবে সিপিএম পিছু হটতে থাকলেও সুনিয়ায় প্রভাব ছিল সিপিএমের। এমনকি কাঁথির দেশপ্রাণ পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূল ক্ষমতা দখল করলেও ওই এলাকার মধ্যে থাকা সুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিল সিপিএমের হাতে।
এরপরে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগে থেকে ফের রাজনৈতিক ভাবে উত্তপ্ত হয় সুনিয়া। তৎকালীন শাসকদল তৃণমূলের সমর্থকদের মারধর, বাড়িঘর ভাঙচুর-সহ সন্ত্রাসের জেরে ঘড়ছাড়া হন সুনিয়া-সহ আশেপাশের কয়েক’টি গ্রামের বহু সিপিএম সমর্থক। বিচ্ছিন্ন ভাবে বেশ কিছু সংঘর্ষ হয়। এমনকি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক-সহ জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা সুনিয়া এলাকার পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে যুযুধান দুই দলের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন।
প্রশাসন সূত্রে খবর, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দলের সমর্থকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তৃণমূল কর্মী নীলাদ্রি মাইতি ও সুনিয়া এলাকার সিপিএম কর্মী মধুসূদন হাজরা। মুগবেড়িয়ার বাসিন্দা নীলাদ্রির মৃত্যু ঘিরে সে সময়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর চলে। এমনকি এলাকার আধিপত্য কায়েম রাখতে বিরোধী দলের কর্মীদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে কাঁথি থেকে সুনিয়াগামী রাস্তায় বাঁশের বেড়া দিয়ে চেকপোস্টও বসিয়েছিল সিপিএম।
কাঁথি থানা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে হলেও অপেক্ষাকৃত দুর্গম সুনিয়ায় রাজনৈতিক সংঘর্ষের পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি হয়েছিল স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে ছবিটা বদলায়। এলাকার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আসে তৃণমূলের হাতে। শুরু হয় বিরোধী সিপিএম সমর্থকদের মারধর, বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা। যেন আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!
রবিবার সেই শুনিয়ায় ঘড়ছাড়া এক সিপিএম নেতার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে ফের উত্তাল হল রাজ্য। এ বার অভিযোগের তীর শাসকদল তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে কাঁথির সিপিএম প্রার্থী তথা দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তাপস সিংহের অভিযোগ, “দীর্ঘ দিন ধরে ঘরছাড়া দলীয় নেতার স্ত্রী-র উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে তাঁকে খুন করেছে তৃণমূলের লোকজন। পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলের নেতা দেবাশিস ভুঁইয়ার নেতৃত্বেই তা হয়েছে।”
তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক মামুদ হোসেন অবশ্য বলেন, “এই ঘটনা সমর্থন করি না। সিপিএম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।” গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই ঘরছাড়া সুনিয়া এলাকার বাসিন্দা সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হংসপদ জানা বলেন, “এলাকায় যে সব বাম কর্মী-সমর্থক রয়েছেন, তাঁদের মোটা টাকা জরিমানা দিয়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে থাকতে হচ্ছে। একটু বেচাল হলেই চলছে অত্যাচার।”
সময় পাল্টেছে, বদল এসেছে নেতৃত্বেও। কিন্তু, সুনিয়া রয়ে গিয়েছে সেই সুনিয়াতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy