সান্তার সাজে কচিকাঁচাদের সঙ্গে নাজিম আহমেদ, ২০১২ সালে (বাঁ দিকে)। নাজিম স্মরণে পোস্টার ছোটবাজারে (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
গালভর্তি সাদা দাঁড়ি, পরনে লাল পোশাক, মাথায় টুপি আর কাঁধে ঝোলা। সেই ঝোলা ভর্তি কেক, চকোলেট, বেলুনের মতো নানা উপহারে।
মেদিনীপুরের অনেক খুদেই এতদিন তাই বড়দিনে সান্তাবুড়োর অপেক্ষায় থাকত।
নরম রোদ্দুর আছে। শীতের আমেজ আছে। বড়দিনও এসে গেল। তবু মনখারাপ শহরের। তাদের সান্তাই যে আর নেই। বেশ কয়েক বছর ধরেই বড়দিনে সান্তা সেজে কচিকাঁচাদের উপহার দিতেন মেদিনীপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান নাজিম আহমেদ। গত এপ্রিলে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গিয়েছেন তিনি। তাই বড়দিনের উৎসবের আগে শহরে, বিশেষ করে নাজিমের বাড়ির এলাকা ছোটবাজারে খুশির রং অনেকটাই ফিকে। কারণ, সান্তাবেশী নাজিমই তো ঘুরে বেড়াতেন শহরতলি থেকে গ্রামগঞ্জে। কখনও পৌঁছে যেতেন হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে। কখনও বৃদ্ধাশ্রমে। কখনও বা জঙ্গলমহলে। সে সবই আজ স্মৃতি।
ক্রিসমাস ইভের আগে স্মৃতিতে ডুব দিয়েছে মেদিনীপুরও। মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্ত বলছিলেন, “নাজিম সাহেব অন্য ধাতের মানুষ ছিলেন। ওঁর একটা রাজনৈতিক মত থাকতে পারে। তবে দেখেছি, সব দলের নেতারাই ওঁকে ভালবাসতেন।” একই মত মেদিনীপুরের তৃণমূল উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাসের। তাঁর কথায়, “নাজিমদা অন্য রকম ছিলেন। কেউ অসুবিধেয় পড়েছে শুনলেই ছুটে যেতেন। পাশে দাঁড়াতেন।” শহরের সিপিএম নেতা হিমাদ্রী দে বলেন, “এই সময় ওঁর কথা খুব মনে পড়ছে। পুরপ্রধান থাকাকালীনই সান্তা সেজে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আজ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।” শহরের কংগ্রেস নেতা সৌমেন খানের আবার বক্তব্য, “নাজিমদার অনেক গুণ ছিল। মানুষকে সম্মান করতে জানতেন। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদও করতেন।”
ছাত্রজীবনে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন। পরে কংগ্রেসে যোগ দেন নাজিম আহমেদ। তারপর ‘বিকাশ পরিষদ’ নামে পৃথক দল গঠন করেন। ১৯৮১ সাল থেকে মেদিনীপুরের কাউন্সিলর ছিলেন নাজিম। তিন দফায় পুরপ্রধানও হন। মেদিনীপুরবাসীর কাছে নাজিম আহমেদ মানেই অন্য কিছু। কখনও বুলডোজারের মাথায় চড়ে বেআইনি নির্মাণ ভেঙেছেন। কখনও পুরসভার ভল্টে টাকা থাকায় সারা রাত পুরভবনের সামনে লাঠি হাতে পাহারা দিয়েছেন। আর বড়দিনের সময় সান্তা সেজে ঘুরে বেরিয়েছেন। শেষের কয়েক বছর নাজিমের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ সানি। এই যুবকেরও মন খারাপ। ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘সত্যিই এই সময়টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একবার উনি সান্তা সেজে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলেন। কয়েকজনকে দেওয়ার পর ঝোলার কেক শেষ হয়ে গিয়েছিল। উনি সব আবাসিককে কেক দেবেনই। শেষমেশ আমাকেই কেক আনতে পাঠিয়েছিলেন। আজকের দিনে এমন মানুষ পাওয়া সত্যিই কঠিন। ক’জন আর রাতে সান্তা সেজে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে যাবেন? উপহার বিলিয়ে শিশুদের মুখে হাসি ফোটাবেন?’ সানি বলছিলেন, “আমার মনে হয়, যাঁদের সামর্থ্য আছে, কাকুর (নাজিম) মতো সমাজের কল্যাণে তাঁদের প্রত্যেকের এগিয়ে আসা উচিত। মানুষ অসুবিধেয় পড়লে তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত।”
গত এপ্রিলে ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দেন প্রাক্তন পুরপ্রধান নাজিম। বর্ণময় মানুষটির এ ভাবে চলে যাওয়া কেউই মেনে নিতে পারেননি। কারণ, তিনি রাজনীতি করলেও সকলকে নিয়ে চলতে ভালবাসতেন। একবার কারও সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলে সহজে তাঁকে ভুলতেন না। কাউন্সিলর হিসেবেও দলমত নয়, মানুষই ছিল তাঁর কাছে একমাত্র পরিচয়। কখনও কাউকে বকলে পরে ভালবেসে কাছে টেনে নিতেন। ভুল করলে পরে শুধরেও নিতেন। পুরপ্রধান হিসেবে আবার নাজিমকে দেখা গিয়েছে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে যাঁর কাছে শৃঙ্খলারক্ষা, পুর-প্রশাসনকে জনমুখী করা, সাধারণ মানুষ ও পুরসভার মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোই ছিল লক্ষ্য। তাই পুজো কিংবা ঈদকে মানুষের মিলন মেলায় পরিণত করতে নিত্য নতুন উপায় খুঁজে বের করতেন। বড়দিনে সান্তাক্লজ সেজে ঘুরে বেড়াতেন।
এ বারও শহর জুড়ে বড়দিনের উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ক্রিসমাস ট্রি, গিফট্ বক্স, জিঙ্গল বেল, রঙিন আলোর সাজ সবই থাকছে। থাকছেন না শুধু নাজিম আহমেদ। এই প্রথম বড়দিনে সেই সান্তাকে ‘মিস’ করছে শহর মেদিনীপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy