সময়টা পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ। সেই সময় পশ্চিম মেদিনীপুরের সব রাস্তা বুড়ামালা, শ্যামচক হয়ে নারায়ণগড়ের কাছে জগন্নাথ রাস্তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর এই পথ গিয়েই দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব।
তবে এই সময়কাল তো সামান্যই। তারও বহু আগে ইতিহাসের পাতায় নাম তুলেছে এই শহর। এখন ডেবরা বলতে অনেকেই বোঝেন বালিচক শহরকে। কোম্পানির সময়কাল থেকেই বালিচক ‘গঞ্জ এলাকা’ বলেই পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই মনে করেন, ডেবরা ব্লকের একমাত্র ডেবরা ও বালিচক শহরের দাবিদার। কারণ ব্লকের বাকি অংশ এখনও গ্রামীণ এলাকা বলেই পরিচিত।
কেমন ছিল এই ডেবরা-বালিচকের সৃষ্টির ইতিহাস?
এক দিকে জনশ্রুতি অন্য দিকে ইতিহাস মিলিয়ে দিয়েছে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। ইতিহাস বলে, পুরাতন নকশায় সাহাপুর পরগনা ও বালিচক কেদারকুণ্ড পরগনার অধীনে ছিল ডেবরা। এই দুই পরগনার সীমানা ভাগ করেছে মেদিনীপুর খাল। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বেশকিছু রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁদের অনেকেই উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসে রাজত্ব অথবা জায়গিরদার স্থাপন করেন। সে ভাবেই রাজা যুগলকিশোর রায় এই সাহাপুর পরগনা সংলগ্ন ‘গড়কিল্লায়’ এসে রাজধানী স্থাপন করেন। ধর্মপরায়ণ রাজা একসময় বিশ্বনাথ দর্শনের জন্য কাশীযাত্রা করেছিলেন। পথে তিনি বিশ্বনাথের স্বপ্নাদেশ পান। কথিত আছে, কাশীযাত্রার বদলে রাজাকে নিজের রাজ্যে কেদারেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেন মহাদেব। রাজা ফিরে এসে সেই নির্দেশ পালন করেন ও শিব মন্দির সংলগ্ন জলাশয়ের ধারে ‘কুণ্ড’ গড়ে তোলেন। সেই থেকে ওই অঞ্চলের নাম হয় কেদারকুণ্ড পরগনা।
অবশ্য এই কেদারকুণ্ডের মন্দিরকে অনেকে চপলেশ্বরের মন্দির বলায় ইতিহাস নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কথিত, ১২৯৭ খ্রীষ্টাব্দে গুজরাতে আলাউদ্দিন খলজির আক্রমণে রাজত্ব হারিয়ে সোলাঙ্কি রাজা দেবনাথ ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরের আশ্রয় নেন। তখন তিনিও স্বপ্নাদেশ পান। রাজাকে মেদিনীপুরের কেদারকুণ্ডুু পরগনার পশ্চিমী চুয়াড়দের অত্যাচার থেকে সামন্ত রাজাদের রক্ষা করার আদেশ দেন মহাদেব। সেই অনুযায়ী রাজা চলে আসেন অধুনা কেদারকুণ্ডে। পরবর্তীকালে রাজা একটি জলাশয়ে খুঁজে পান বিশালাকার শিবলিঙ্গ। সেই জলাশয়ের ধারেই একটু উঁচু জমিতে ১২৯৯ সাল নাগাদ ওই চপলেশ্বর মন্দির গড়ে তোলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, এর পরেই রাজা দেবনাথ ‘রায়’ উপাধি পেয়েছিলেন। সেখান থেকেই রাজ্যের নাম ‘দেবরায়’ হয়ে পরে ‘ডেবরা’ হয়েছে।
অবশ্য ডেবরা যে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল তার ধ্বংসাবশেষ এখনও টাটকা। ইতিহাস বলছে, ডেবরা ছিল বাংলা ও ওড়িশা যাওয়ার সংযোগস্থল। ডেবরা ব্লকের ভবানীপুর, মাড়োতলা, ওপর দিয়ে ডেবরা পর্যন্ত যে রাস্তাটি এখন রয়েছে তা আগে ‘নন্দকাপাশা জাঙ্গাল’ নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় জেলার সব রাস্তা এই নন্দকাপাশা জাঙ্গালের সঙ্গে মিলত। এখন এটিই ডেবরা থেকে বুড়ামালা পর্যন্ত জাতীয় সড়কে মিশে গিয়েছে আর এই রাস্তাই তখন বুড়ামালা, শ্যামচক হয়ে নারায়ণগড়ের কাছে জগন্নাথ রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে এই রাস্তা দিয়েই শ্রীচৈতন্য দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন। তবে তার আগেই পাঠান রাজত্বকালে এই জগন্নাথ রাস্তা ও নন্দকাপাসা রাস্তার মাঝামাঝি অংশে আলিশাহ নামে এক ব্যক্তি জায়গিরদারি নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখন এই এলাকাটি ডেবরার আলিশাহগড় ও এর পূর্ব অংশের ‘বাহিড়গর’ যা এখন বাড়াগড় নামে পরিচিত। আর ওই আলিশাহ সেই সময় নিজের গুরু সাহাবুদ্দিনের নামানসারে সাহাপুর পরগন গড়েছিলেন বলে জানা যায়।
ইতিহাসের সরণী বেয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা ডেবরায় এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। হাওড়া-খড়্গপুর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বালিচক স্টেশনকে ঘিরে ক্রমশ বাড়তে থাকে ডেবরার বসতি। সোনালী চতুর্ভূজ প্রকল্পে দুই লেন থেকে ছয় লেন হয়েছে। সেই সঙ্গে মুম্বই-কলকাতা ৬ন ম্বর জাতীয় সড়কের ডেবরা থেকে সবং সড়কের মধ্যবর্তী অংশে বালিচক অবস্থিত হওয়ায় উন্নত বাস যোগাযোগ ব্যবস্থাও দীর্ঘদিন ধরেই। তাই পিংলা, সবং, নারায়ণগড়, খড়্গপুর গ্রামীণের করিডর হিসেবে বালিচকই ব্যবহার হয়ে এসেছে। আবার ডেবরা ব্লকের অধিকাংশ অফিস থেকে থানা সবই বালিচক এলাকায়। তাই কর্মরত মানুষের সেরা গন্তব্য বালিচক স্বভাবতই বসতি বাড়ছে লাফিয়ে। অনেকেই যোগাযোগের স্বার্থে এই শহরকে ঠিকানা করেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর দশেক আগের জমির দাম বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় চারগুণ। এ দিকে এলাকার পরিধি বাড়ার সঙ্গেই নাগরিক পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখনও ডেবরা-বালিচকে নর্দমা না থাকায় সুষ্ঠু নিকাশিতে জেরবার নাগরিকরা, নেই জঞ্জালের ভ্যাট। ডেবরার অধিকাংশ রাস্তাই কাঁচা অথবা মোরামের বালিচকে একটি সজলধারা প্রকল্পে পানীয় জল সরবরাহ করা হলেও পর্যাপ্ত নয়। তাই পঞ্চায়েত এলাকা হলেও ধীরে ধীরে পুরসভা করার দাবি তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
কী বলছে পঞ্চায়েত সমিতি? সমিতির সভাপতি মুনমুন সেন মণ্ডল বলেন, “সত্যিই কিছু ক্ষেত্রে বসতি বাড়ায় সমস্যা হচ্ছে। খুব দ্রুত নিকাশি নালাগুলি খননের ব্যবস্থা করব।”
অপেক্ষায় ডেবরার বাসিন্দারা।