জল্পনা চলছিলই। আভাস দিয়েছিলেন তিনি নিজেও। সেই মতোই রবিবার বিজেপিতে যোগ দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি তথা সিপিএমের পিংলা জোনাল কমিটির কমিটির সদস্য অন্তরা ভট্টাচার্য। লোকসভা নির্বাচনে সাফল্যের পর জেলার অনেক বাম কর্মী-সমর্থকই গেরুয়া-শিবিরে নাম লেখাতে শুরু করেছিলেন। তবে সেই অর্থের মাথার দিকের কারও বিজেপিতে যাওয়া এই প্রথম। ফলে, অন্তরাদেবীর দলবদল সিপিএম তথা বাম শিবিরকে নাড়া দিয়ে গেল।
অন্তরাদেবী বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন বলে গত কয়েক দিন ধরেই জেলার রাজনৈতিক মহলে জল্পনা চলছিল। খবরটা জানতে পেরে পিংলার এই নেত্রীর মন রাখতে তৎপর হয়েছিলেন সিপিএমের জেলা নেতৃত্বও। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের দূত হয়ে বারবার প্রাক্তন সভাধিপতিকে ফোন করেছেন সুভাষ দে, মেঘনাদ মাইতিরা। তবে শেষরক্ষা হল না। এ দিন অন্তরাদেবী বলেন, “মানুষের জন্যে কাজ করার ইচ্ছে থেকেই বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছি। আশা করি, তা করতে পারবো।” অন্তরাদেবী দলে আসায় স্বভাবতই খুশি বিজেপি নেতৃত্ব। দলের জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, “অন্তরাদেবী সিপিএমে থাকলেও প্রশাসন পরিচালনায় স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ছিল তাঁর। তাই তাঁকে দলে নিতে আমরা দেরি করতে চাইনি”
অন্তরা ভট্টাচার্যের বিজেপিতে যোগ দেওয়া দলের পক্ষে বড় ধাক্কা বলে মানছে সিপিএমের একাংশ। অবশ্য দলের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার সে কথা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “আমাদের দল স্বেচ্ছা প্রতিষ্ঠান। অনেকে আসেন। অনেকে যান। উনি দলের সদস্য ছিলেন। জেলায় এ রকম ৩২ হাজার সদস্য আমাদের দলে আছেন।” দীপকবাবুর আরও ব্যাখ্যা, সিপিএম দল অনেকটা রেলগাড়ির মতো। মেদিনীপুর থেকে যাঁরা হাওড়া লোকালে ওঠেন, তাঁদের কেউ খড়্গপুরে, কেউ পাঁশকুড়ায় নেমে যান। সকলে হাওড়া পর্যন্ত যান না। বুঝতে হবে, যাঁরা হাওড়া পর্যন্ত যান না, হয় তাঁদের হাওড়া পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে নেই, নয়তো যোগ্যতা নেই!
দীপকবাবু যা-ই বলুন না কেন দীর্ঘ দিন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্তরাদেবীর বিজেপিতে যোগদান বাম শিবিরের পক্ষে বড় ক্ষতি। পিংলার এই নেত্রীর শিক্ষক-পিতা রঘুনাথ ভট্টাচার্য নিজে রাজনীতি থেকে দুরে থাকতেন। তবে তাঁর কাকার সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির নিবিড় যোগ ছিল। সেই সূত্রে বাড়িতে সিপিএম নেতাদের যাতায়াতও ছিল। সেই আবহেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি ইতিহাসে স্নাতকোত্তর অন্তরাদেবীর। ১৯৯৮ সালে প্রথম তিনি পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী করা হয়। জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও হন। ফের ২০০৩ সালের নির্বাচনে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন তিনি। ২০০৮ সালে দল তাঁকে জেলা পরিষদের প্রার্থী করে। সে বারও জিতে জেলা সভাধিপতির পদ পান অন্তরাদেবী। নিজে বরাবর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিয়ে কাজ করেছেন। তবে দলীয় নেতৃত্বের একরোখা মনোভাবের কারণে বারবার সঙ্ঘাতও হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই জেলা জুড়ে বাম বিপর্যয় শুরু হয়। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অন্তরাদেবী জেলা পরিষদের প্রার্থী হয়ে হেরে যান। তার পরেও অবশ্য সিপিএমের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়নি। সেটা হয় কিছু দিন আগে থেকে।
জানা গিয়েছে, সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব দীর্ঘ দিন অন্তরাদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ফোন করেও খবর নেননি। দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা যখন আক্রান্ত, তখনও পাশে এসে দাঁড়াননি সিপিএম নেতারা। দলীয় সূত্রে খবর, তিনি বিজেপিতে যাচ্ছেন খবর পেয়ে যখন সিপিএম নেতারা অন্তরাদেবীকে ফোন করেন, তখনও ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। বলেন, “এক বছরে একদিনও খোঁজ নেওয়ার সময় হয়নি। এখন বারবার ফোন করছেন কেন? আমি সভাধিপতি ছিলাম, ভুলে যাওয়ার মতো সাধারণ কর্মী বা সমর্থক ছিলাম না। আমার ক্ষেত্রেই যদি দল এমন আচরণ করে, তাহলে সাধারণ নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে বোঝাই যায়।” অন্য দিকে দেখা গিয়েছে, কোনও গ্রামে বিজেপি কর্মী আক্রান্ত হলেই বিজেপি নেতৃত্ব সেখানে ছুটে গিয়েছেন। একদিকে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি অভিমান-ক্ষোভ, অন্য দিকে বিজেপি নেতাদের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখে ভাল লাগা এই দুইয়ের সমাপতনই অন্তরাদেবীকে বিজেপির প্রতি টেনে নিয়ে গিয়েছে।
কেন অন্তরাদেবীর সঙ্গে দল যোগাযোগ রাখল না? সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপকবাবুর অবশ্য জবাব, “দল নানা বিষয়েই সহযোগিতা করেছে। পাশে থেকেছে। এ নিয়ে বেশি কিছু বলবো না।” এ দিকে, সিপিএম সূত্রের খবর, শনিবার দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে অন্তরাদেবীর দলত্যাগের প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়। অন্তরাদেবীর বাড়ি পিংলার রঘুনাথচকে। জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে পিংলায় দলের কাজকর্ম দেখভাল করেন সুভাষ দে। কেন দল ছাড়ার বিষয়টি আগে জেলা নেতৃত্বের কাছে পৌঁছলো না, সেই প্রশ্নও তোলেন দীপকবাবু। তবে বৈঠকে সিপিএমের জেলা সম্পাদক এ-ও বুঝিয়ে দেন, কেউ দল ছাড়তে চাইলে তাঁকে জোর করে আটকে রাখা যায় না।
শেষ মুহূর্তে অন্তরাদেবীকে দলে টানতে তৎপর হয়েছিল তৃণমূলও। তৃণমূলের এক সূত্রেই খবর, শুক্রবার রাতে প্রাক্তন সভাধিপতির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়। বিজেপিতে না গিয়ে তৃণমূলে আসার প্রস্তাব দেন। পরে জেলাস্তরের একাধিক তৃণমূল নেতাও অন্তরাদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রাক্তন সভাধিপতি অবশ্য জানিয়ে দেন, তিনি বিজেপিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এ নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব কিছু বলতে চাননি। তবে অন্তরাদেবী মানছেন, “কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। ওঁরাই আমাকে ফোন করেছিলেন।”