Advertisement
E-Paper

সঙ্কট, তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন হলদিয়ার

চিত্র এক: বাম আমলে শহরের সিটি সেন্টারে হয়েছিল ঝকঝকে শপিং মল ‘সোনার তরী’। কিন্তু তৈরিই সার। চালুই হয়নি মলটি। বন্ধ হয়ে গিয়েছে শহরের নানা শপিং মল, আবার নতুন মল ভেঙে হয়েছে আবাসন। চিত্র দুই: কলকাতা-হলদিয়া নদীপথে বন্ধ হয়ে সিলভার জেট। দু’-দু’বার চালু হয়েও যাত্রীর অভাবে আপাতত বন্ধ কলকাতা হলদিয়া উড়ান পরিষেবাও। হলদিয়ার তিন দিক নদী ঘেরা থাকলেও নেই জেটি বা উন্নত ফেরি পরিষেবা।

অমিত কর মহাপাত্র

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৪ ০১:০১
চালুই হয়নি সিটি সেন্টারের শপিং মল ‘সোনার তরী’। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।

চালুই হয়নি সিটি সেন্টারের শপিং মল ‘সোনার তরী’। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।

চিত্র এক: বাম আমলে শহরের সিটি সেন্টারে হয়েছিল ঝকঝকে শপিং মল ‘সোনার তরী’। কিন্তু তৈরিই সার। চালুই হয়নি মলটি। বন্ধ হয়ে গিয়েছে শহরের নানা শপিং মল, আবার নতুন মল ভেঙে হয়েছে আবাসন।

চিত্র দুই: কলকাতা-হলদিয়া নদীপথে বন্ধ হয়ে সিলভার জেট। দু’-দু’বার চালু হয়েও যাত্রীর অভাবে আপাতত বন্ধ কলকাতা হলদিয়া উড়ান পরিষেবাও। হলদিয়ার তিন দিক নদী ঘেরা থাকলেও নেই জেটি বা উন্নত ফেরি পরিষেবা।

চিত্র তিন: দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে করতে হলদিয়ার রামনগরের কাপড়ের ব্যবসায়ী এমদাদুলের আফশোস, “কয়েক বছর আগেও এত চালু ব্যবসা ছিল, যে বাড়িতে খেতে যাওয়ার সময়টুকুও পেতাম না। এখন ব্যবসা হচ্ছে কোথায়? ”

এই আফশোস শুধু এমদাদুল ইসলামের নয়, সেই একই সুর হলদিয়ার অনেক বাসিন্দারই। যে নদী জন্ম দিয়েছিল হলদিয়া ভূখণ্ডকে, শিল্প ও বাণিজ্যের দুনিয়ায় এই শহরকে করে তুলেছিল গতিময়, সেই হুগলি ও হলদি নদীর নাব্যতা কমেছে। আর তার সঙ্গেই কেমন যেন থমকে গিয়েছে শহুরে হলদিয়ার অগ্রগতি।

আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের মতে, নদী ও উপসাগরের মিলনস্থলে কাঁসাই নিম্ন সমভূমির দক্ষিণাংশে ত্রয়োদশ শতকে যে চরভূমি জেগে উঠেছিল, ১৭২২ সালে নবাবি আমলে সেই নিমক মহালের নাম হয় দোরো দুবনান পরগনা। পঞ্চাশ বছর পরে স্থানীয় ও বহিরাগত মানুষদের নিয়ে লবণ উৎপাদন ও বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে হলদিয়ার চলা শুরু। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এলাকার জমি জরিপের দায়িত্ব পান জে এইচ মেন্ডিস। ক্রমে জমির মালিকানার হাতবদল হয়েছে বারবার। দোরো দুবনানের ১৮৬টি গ্রামের মধ্যে ৬৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় আধুনিক হলদিয়া। ১৯৫৯ সালের ৮ জুন সাড়ে ছ’একর জমি নিয়ে অ্যাঙ্কারেজ ক্যাম্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কলকাতার সহায়ক হলদিয়া বন্দর প্রকল্পের সূচনা হয়। সেই দিনটিকেই হলদিয়ার জন্মদিন হিসাবে পালন করেন এলাকার বাসিন্দারা। ১৯৬৩-৬৪ সালে শুরু হয় বন্দর নির্মাণ। ১৯৭৫ সালে আইওসি, ১৯৭৯ সালে টাটা কেমিক্যালস, ১৯৮১ সালে এক্সাইড ও পরবর্তীকালে নানা সংস্থা হলদিয়ায় শিল্পস্থাপন করে। আর বন্দর ও শিল্পের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে পরিকল্পিত বসতি এলাকা, স্কুল-কলেজ। ১৯৮৮ সালে জন্ম হয় হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের আর ১৯৯৭ সালে হলদিয়া পুরসভার।

অনেক দিন ধরেই কমছিল হলদিয়া বন্দরের নাব্যতা। লোকসানে চলতে থাকা কলকাতা বন্দর হলদিয়া বন্দরের লভ্যাংশের উপর নির্ভরশীল। সমস্যায় জেরবার হলদিয়া, কলকাতার মতো মৃতপ্রায় বন্দরের বোঝা নিয়ে ক্রমশ নুব্জ হয়ে পড়তে থাকে। কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট ও রাজ্যে বাম আমলে হওয়া ভারত বাংলাদেশ জলচুক্তির ফলে ড্রেজিংয়ের জন্য কেন্দ্রের তরফে নিয়মিত টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তা রক্ষিত হয়নি। তবে হলদিয়া বন্দরের প্রশাসনিক ম্যানেজার অমল দত্ত জানিয়েছেন, “ড্রেজিং-এর জন্য দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ চলছে।” এই পরিস্থিতিতে কেমন যেন বদলাতে থাকে শহরটা। গত কয়েক বছরে তেমন কোনও বড় বেসরকারি আবাসন এই শহরে গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীরা জনিয়েছেন, আগে ব্যবসার কাজে অনেকে শহরে আসতেন। এখন সেই সংখ্যা কমে গিয়েছে অনেকটাই। ফলে মার খাচ্ছে হোটেল ব্যবসাও। দুর্গাচকের সুজয় পাত্র, বাসুদেবপুরের নুর আলম বৈদ্যদের মতো যুবক কর্মপ্রার্থীরা তাই অকপটেই বলেন, “হলদিয়ার যেটুকু মূল্য আছে তা কেবলমাত্র বন্দর ও শিল্পের জন্য। শিল্পে নতুন লগ্নি না আসায় হলদিয়ার অবনমন শুরু হয়েছে। আমরা হতাশাগ্রস্ত।” হলদিয়া শহরে জমি বাড়ন্ত বলা হচ্ছে অথচ ১৯৮৭ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশনের বিপুল জমি ও সম্পদের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। রাজ্য সরকারের অংশ থাকা অন্যতম বৃহৎ শিল্প সংস্থা হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস সম্প্রতি এক মাস ধরে বন্ধ থাকায় শিল্পশহরের শিল্পচিত্র নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

আশার কথা অবশ্য একটাই, স্থানীয় সাংসদ তথা হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান শুভেন্দু অধিকারী শিল্পের অবনমন আটকাতে পৃথক হলদিয়া পোর্ট ট্রাস্ট গঠনের দাবিতে সরব হয়েছেন। শিল্প আনার ক্ষেত্রেও নিজের মতো করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শুভেন্দুবাবুর দাবি, “বাম আমলের শেষের দিকে হলদিয়ায় শিল্পে যে নেতিবাচক অবস্থা ছিল, রাজ্যে পরিবর্তনের পরে তার অনেকটাই বদল হয়েছে। নতুন শিল্প স্থাপন ও কিছু শিল্পের সম্প্রসারণ প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলেছি।” তৃণমূল সাংসদ আরও জানালেন, রাজ্যে পালাবদলের পরে চালু হয়েছে ধানসেরি পেট্রোকেমিক্যালস, ভোজ্য তেল প্রস্তুতকারক সংস্থা জেভিএল। চালুর মুখে বাণেশ্বরচকের সিইএসসির তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। শুভেন্দুবাবুর দাবি, “হলদিয়ায় শিল্পে জোয়ার চলছেই।”

ইতিবাচক ভাবে মারামারি, হানাহানি, অপরাধপ্রবণতাও কমেছে এই শিল্পশহরে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হলদিয়া) অমিতাভ মাইতির মতে, কয়েক বছর আগেও হলদিয়ায় ছোটখাট সংঘর্ষ ছিল প্রায় নিত্যকার ঘটনা। ইদানীং অবশ্য সে সব বিশেষ হয় না। পুলিশ-প্রশাসনের কড়া মনোভাবের জন্যই হলদিয়ায় শান্তি ফিরেছে বলে দাবি তাঁর।

হলদিয়াকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার নানা পরিকল্পনার কথাও শোনাচ্ছে পুর-প্রশাসন। যেমন পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ মণ্ডলের দাবি, “কয়েকমাস আগে ক্ষমতায় এসেই আমরা সামগ্রিকভাবে শিল্পসংস্থা ও পুরবাসীদের জন্য পরিকাঠামো গড়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছি। ‘সোনার তরী’ চালুর চেষ্টা চলছে।” এলাকার সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও শোনালেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। বললেন, “শিল্প কারখানার শ্রমিক কর্মীদের বেতন বেড়েছে। শিল্প-সহ নানা ক্ষেত্রের জন্য পরিকাঠামো গড়ে হচ্ছে।” গত এক বছরে বন্দরে পণ্য আমদানি বেড়েছে বলেও সাংসদের দাবি। একই সঙ্গে তিনি মানছেন হলদিয়া বন্দরের সঙ্কটের কথা। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “যথাযথ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বাড়ানোর জন্য বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিংয়ের দাবি জানিয়েছি। পৃথক হলদিয়া পোর্ট ট্রাস্ট গঠনের জন্য সংসদে সওয়াল করেছি। এইচপিটি গঠন না হলে হলদিয়া বন্দরকে বাঁচানো যাবে না।”

হলদিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করার যে স্বপ্ন ইতিমধ্যেই দেখাতে শুরু করেছেন সাংসদ, আপাতত তা পূরণের অপেক্ষায় হলদিয়া।

amit kar mahapatra haldia amar sohor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy