ভূপাল সামন্ত ও সুরজিৎ মাইতি
একশো দিনের কাজ প্রকল্পে একটা ‘জব কার্ডে’র জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন ভূপাল সামন্ত। কাজ চাই যে!
ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ আছে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা। লাফিয়ে বাড়ছে সংসার খরচও।
এতদিন এ সব নিয়ে ভাবতে হতো না বছর আটত্রিশের ভূপালকে। সেই ১৪ বছর বয়সে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখান থেকে কাজ নিয়ে যান জলগাঁওয়ের একটি সোনার দোকানে। তাঁর টাকাতেই মাটির বাড়ি পাকা হয়েছে। সংসার চলেছে সাবলীল ভাবে। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন তাঁর বাড়ির লোক।
সেই ভূপালই এখন সঙ্কটে। নোট-কাণ্ডের জেরে জলগাঁওয়ের সেই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভূপাল গ্রামে ফিরেছেন। কিন্তু কী করবেন এখানে? তাই সকাল থেকে রাত— কখনও তিনি পঞ্চায়েত সদস্যের বাড়িতে, কখনও গ্রামের নেতার কাছে দরবার করছেন। যাতে ১০০ দিনের কাজে গায়ে-গতরে খেটে কিছু পাওয়া যায়!
ভূপালের মতোই ভাল নেই সুমন বেরা, আশিস সামন্ত, সুরজিৎ মাইতিরা। হুগলি জেলার প্রত্যন্ত এলাকা খানাকুলের ধান্যগড়ি পঞ্চায়েতের এই মানুষেরা সকলেই একই কাজে গিয়েছিলেন মুম্বই। কেউ ১২ বছর আগে, কেউ ১০, কেউবা মাত্র কয়েক বছর আগে। ফিরে এসেছেন অনেকেই। অন্যান্য বার বড়দিনের আগে তাঁরা ফিরলে বাড়িতে তো বটেই, গ্রামেও হই-হুল্লোড় হতো। এ বার তাঁদের ‘ঘর ওয়াপসি’তে কোথাও আনন্দ নেই। শুধুই বিষণ্ণতা।
আমলা পাঠিয়ে কেন্দ্র সরকার ইতিমধ্যেই ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়ার মানুষদের উল্টো স্রোতের (রিভার্স মাইগ্রেশন) কথা জানতে পেরেছে। কিন্তু এর জেরে গ্রামের অর্থনীতিও যে বিপন্ন হচ্ছে তার একটি চিত্র উঠে এসেছে ধান্যগড়ি থেকে।
কেমন সে চিত্র? ধান্যগড়ি পঞ্চায়েত এলাকাটি রূপনারায়ণ নদীর ধারে। উল্টো দিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল। ধান্যগড়ি, কাগনান এবং ঘোড়াদহ— তিনটি গ্রামকে নিয়ে ধান্যগড়ি পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ২৬০০ পরিবারের বাস। অনেকেই সামান্য জমিতে চাষ বা দিনমজুরি করেন। তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। গ্রামের যাঁদের অবস্থা কিছুটা ভাল, তাঁদের পরিবারের কেউ না কেউ এত দিন সোনা বা জরির কাজ করছিলেন মুম্বই ও মরাঠা মুলুকের অন্যত্র। সেই সংখ্যাটা অন্তত ৪০০। তাঁরা প্রতি মাসে বাড়িতে ৬ হাজার থেকে ১০-১২ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠাতেন। মূলত সেই টাকাই এই এলাকার নানা ছোটখাটো কারবারকে চাঙ্গা রাখত। কিন্তু নোটের চোটে তাঁদের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টান পড়েছে সেই সব কারবারেও।
এতদিন এই তল্লাটের বন্দর বাজার এলাকা সবসময় জমজমাট থাকত। এখন হাতেগোনা লোক দেখা যায়। ওই বাজারে চপ-ঘুগনির দোকান রয়েছে বীরেন সাহার। তাঁর আক্ষেপ, “বাইরে কাজে যাওয়া ছেলেগুলো ফিরে আসছে। মাসখানেক আগে পর্যন্ত সকাল-বিকেল মিলিয়ে প্রায় হাজার টাকার বিক্রি হতো। এখন ৪০০ টাকারও বিক্রি হচ্ছে না।’’ ওই বাজারেরই চা-দোকানি গণেশ সাহা বলেন, ‘‘সারাদিনে আগে ৩০০ টাকার ব্যবসা হতো। এখন ৭৫ থেকে ১০০ টাকায় ঠেকেছে। কে কিনবে?’’ আর এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘নোট বাতিলের জেরে বিক্রিবাট্টা আগে থেকেই কমছিল। কিন্তু ছেলেগুলো যে ফিরে আসবে, সেটা ভাবিনি। সেটা আরওবড় ধাক্কা হল আমাদের কাছে।’’ বিক্রি নেই ময়রার দোকানে। মাছি তাড়াচ্ছেন গামছা-লুঙ্গির ব্যাপারী। গাঁয়ে সে ভাবে চোখে পড়ছে না তেল-সিঁদুর-প্রসাধনী বিক্রির ফেরিওয়ালাদেরও।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর থেকে এ পর্যন্ত কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছেন শ’খানেক গ্রামবাসী। বাকিদেরও ফেরা ছাড়া পথ নেই, বলছে অনেক পরিবারই। ভূপালই বলছেন, ‘‘কবে কাজ পাব জানি না। জমানো টাকা টিপে টিপে খরচ করতে হচ্ছে। নিতান্ত দরকার না পড়লে কেনাকাটাও বন্ধ।’’ একই কথা বলছেন মুম্বই ফেরত অন্য যুবকরাও। এরই প্রভাব পড়েছে গ্রামের সব ক্ষেত্রে। শুধু গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখাই নয়, বাইরে কাজে যাওয়া ওই যুবকদের টাকায় গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে বেশ কিছু। যেমন, স্কুলভবন তৈরি, মন্দির-মসজিদ সংস্কার ইত্যাদি। এতদিন বছর শেষে যাঁরা বাড়ি ফিরতেন, তাঁদের কেউ কেউ দুঃস্থদের কম্বল দিতেন। এ বার সেটাও বন্ধ। ধান্যগড়ি ক্লাবের কনক সানকি নামে এক সদস্য বলেন, ‘‘বন্যার সময়ে ওঁদের টাকায় ত্রাণ শিবিরও হয়েছে। এখন ছেলেগুলো শুকনো মুখে ফিরছে, এ দৃশ্য দেখতে আর ভাল লাগছে না।’’
‘অচ্ছে দিন’ অতীত। বলছে ধান্যগড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy