Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দুধের ঋণ নিয়ে বেঁচে আছে মাতৃহারা সদ্যোজাত

যার কেউ নেই তার নাকি উপরওয়ালা থাকে। ছোট্ট বুবু পৃথিবীতে চোখ মেলার পরে যখন মা-কে হারাল তখন সেই অদৃশ্য উপরওয়ালাই বোধহয় তার জন্য অনেকগুলো মা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মায়েদের জাতি-ধর্ম-গোত্র এক এক রকম। তাঁরাই টানা দেড় মাস বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ফুটফুটে শিশুকে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ২১:২৫
Share: Save:

যার কেউ নেই তার নাকি উপরওয়ালা থাকে। ছোট্ট বুবু পৃথিবীতে চোখ মেলার পরে যখন মা-কে হারাল তখন সেই অদৃশ্য উপরওয়ালাই বোধহয় তার জন্য অনেকগুলো মা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মায়েদের জাতি-ধর্ম-গোত্র এক এক রকম। তাঁরাই টানা দেড় মাস বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ফুটফুটে শিশুকে। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অজস্র অভিযোগের মধ্যেই ব্যতিক্রমী যত্ন নিয়েছিলেন চিকিৎসক ও নার্সরাও। তা না হলে বুবু-র তো বাঁচারই কথা নয়।

তাকে জন্ম দিয়েই মা মারা গিয়েছিলেন। বুবু-র পরিবার যখন পরিজনের বিয়োগযন্ত্রণা এবং সদ্যোজাত-র ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা ঠিক তখনই জানা গেল আর এক দুঃসংবাদ। জন্ম থেকেই দুধে অ্যালার্জি নবজাতকের। অর্থাৎ, মায়ের দুধ তো পাবেই না, তার উপর গরুর দুধ বা কৌটোর দুধ কিছুই সহ্য হবে না ছোট্ট বুবু-র। তাকে বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রায় অসাধ্য হয়ে উঠেছিল। আর কোনও উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজি বিভাগে মায়েদের কাছে গিয়ে সাহায্য ভিক্ষা করেন চিকিৎসকেরা। সঙ্গে ছিলেন বুবু-র বাবা বাসুদেব দাস। দু’হাতে সদ্যোজাতকে তুলে ধরে তিনি অন্য মায়েদের বলেছিলেন, ‘‘আপনারা এগিয়ে এলে এই বাচ্চা বাঁচতে পারে, নয়তো ও মারা যাবে।’’

মারা যেতে হয়নি। বরং টানা দেড় মাস তাকে কে দুধ খাওয়াবে তা নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল মায়েদের মধ্যে। প্রাথমিক ভাবে শারীরিক দিক থেকে তাকে খানিকটা সবল করার পর এক ধরনের বিদেশি ‘হাইপো অ্যালার্জিক ফরমুলা’ অপেক্ষাকৃত কম দামে কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ঠিক এক বছর বাদে এই মার্চে জন্মদিন পালন করার পরে বাবার কোলে চড়ে নিওনেটোলজির ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে দেখা করে এসেছে বুবু। একসময় সে মরতে বসেছিল, এখন সে ১৫ কিলো ৯০০ গ্রামের হৃষ্টপুষ্ট শিশু। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তার সেই মায়েদের অনেকেই। বুবুকে বুকে জড়িয়ে যাঁদের অনেকেরই চোখের জল থামতে চায়নি।

এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজির প্রধান সুচন্দ্রা মুখোপাধ্যায় জানালেন, জন্মের তিন ঘণ্টার মধ্যে শিশুর মা মমতা দাস হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর পর শিশুকে কৌটোর দুধ দেওয়া হয়েছিল। খাওয়ার পরেই তার ডায়েরিয়া শুরু হয়। তখন শারীরিক পরীক্ষা করে তার দুধে অ্যালার্জির বিষয়টি জানা যায়। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান চিকিৎসকেরা। সুচন্দ্রাদেবীর কথায়, ‘‘সদ্যোজাতকে তো গলা ভাত, সবজি খাওয়ানো সম্ভব নয়। দিনে অন্তত ৮-৯ বার শিশুকে আড়াইশো থেকে তিনশো মিলিলিটার করে দুধ খাওয়ানো দরকার। এবং এই শিশুর ক্ষেত্রে সেটা শুধুমাত্র বুকের দুধ হতে হত। তখন নিওনেটোলজিতে ভর্তি অন্য শিশুদের মায়ের কাছে অনুরোধ জানানো ছাড়া উপায় ছিল না। এক বার বলতেই সবাই রাজি হন। হাসপাতালের মাতৃদুগ্ধ ব্যাঙ্ক ‘মধুর স্নেহ’-তে সঞ্চিত দুধও ওই শিশুটিকে দেওয়া হয়েছে।

শিশু বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘এটা একটা অদ্ভুত জটিল সমস্যা। এই পরিস্থিতিতে প্রথমে আমরা বাচ্চাকে সয়াবিনের দুধ দিয়ে দেখি। কিন্তু যাদের দুগ্ধ প্রোটিনে অ্যালার্জি থাকে তাদের ৩৫-৫০ শতাংশের সয়াবিনের দুধেও অ্যালার্জি হয়। তখন অত্যন্ত দামি কিছু বিদেশি হাইপো অ্যালার্জিক ফর্মুলা খাওয়ানো ছাড়া গতি নেই। এই শিশুটির ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে অন্য মায়েরা অন্তত প্রথম দেড় মাস সেই খরচও বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।’’

বুবু ওরফে দেবাঞ্জনের বাবা বাসুদেব বলছিলেন, ‘‘এ ভাবে মায়েদের থেকে সাড়া পাব ভাবিনি। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই দুধ খাইয়েছে আমার ছেলেকে। এক মা-কে হারিয়ে অনেক মা-কে পেয়েছে ও।’’ এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দুগ্ধদাত্রীর কোনও রোগ আছে কি না এবং তার দুধের গুণাগুণ যথাযথ কি না তা পরীক্ষা করেই তা শিশুকে খাওয়ানোর অনুমতি মেলে। বুবু-র ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩ মার্চ বুবুর জন্মের পর টানা দেড় মাস এ ভাবেই চলেছে। তার পর বাড়ি গিয়েছিল বুবু। আপাতত হাওড়ার জগাছার বাড়িতে বাবা, ঠাকুমা আর পিসির সঙ্গে বেড়ে উঠছে ছটফটে, ছোট্ট ছেলে। ফুটন্ত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুধের ঋণ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

MilkBank Newborn Motherless
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE