টিভির সামনে বসে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছেন মাঝবয়সী মহিলা। সবংয়ের কলেজে এক ছাত্রকে পিটিয়ে মারার খবর দেখানো হচ্ছে।
আর তাই দেখতে দেখতে চোখ ভেসে যাচ্ছে আন্দুলের রেবা কোলের। নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘‘ফের সবংয়ে এক মায়ের বুক খালি হল। অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছে, আর মায়েরা কাঁদছি! এ কোন রাজ্যে আমরা বাস করছি!’’
প্রায় পাঁচ বছর আগে রেবাদেবীর ছোট ছেলে স্বপনকে এ ভাবেই কলেজের মধ্যে পিটিয়ে মেরেছিল এক দল যুবক। যাদের অধিকাংশ তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর সদস্য বলে পরিবারের দাবি। পাঁচ বছর কেটে গেলেও অবশ্য কারও সাজা হয়নি। উল্টে মূল অভিযুক্তের ‘পদোন্নতি’ হয়েছে দলীয় সংগঠনে। স্বপন-খুনের মামলায় জামিন পেয়ে তিনি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ব্লক সভাপতি থেকে হয়েছেন জেলা সভাপতি (গ্রামীণ)!
২০১০-এর ১৬ ডিসেম্বর হাওড়া আন্দুলের প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে এসএফআই-সমর্থক স্বপন কোলেকে খুনের ওই ঘটনায় জড়িত হিসেবে সুতনু পোল্লে, সৌরভ সাঁতরা এবং টিমসিপি’র তৎকালীন সাঁকরাইল ব্লক সভাপতি তুষারকান্তি
ঘোষ-সহ ১৩ জনের নাম উঠে এসেছিল। হত্যাকাণ্ডের পরে সৌরভ গ্রেফতার হন।
ক’মাস বাদে ধরা পড়েন সুতনু-সহ দু’জন। পুলিশের একাংশের দাবি: সৌরভ স্বীকার করেছিলেন যে, টিএমসিপি সমর্থকদের হাতেই স্বপনের প্রাণ যায়। কিন্তু তদন্তকারীরা সময়মতো চার্জশিট না-দেওয়ায় অভিযুক্তেরা জামিন পেয়ে গিয়েছেন বলে জেলা পুলিশের অন্দরেই আক্ষেপ শোনা গিয়েছে। বস্তুত তুষারও তখন হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়ে যান।
এবং পুলিশেরই অনেকে জানাচ্ছেন, রাজ্যে পালাবদলের পর স্বপন হত্যা-তদন্তের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের বদলি করে দেওয়া হয়। চার্জশিট জমা পড়ে ঘটনার আড়াই বছর বাদে, ২০১৩-য়। তার পরে চার্জগঠন পর্ব পেরিয়ে এখন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব চলছে। ‘‘এক জন পড়ুয়াকে খুনের মামলা যে এত হেলাফেলায় করা যায়, না-দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন!’’— মন্তব্য জেলার এক পুলিশকর্তারই।
হাওড়ার এসপি (গ্রামীণ) সুকেশ জৈন অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। অন্য দিকে দলীয় সূত্রের খবর: তুষার আগাম জামিন পাওয়ার পরেই, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে টিএমসিপি-র হাওড়া জেলা (গ্রামীণ) সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ছাত্র খুনের মামলার মূল অভিযুক্তকে একেবারে জেলা সংগঠনের মাথায়?
প্রশ্ন শুনে তুষারের মধ্যে কোনও ভাবান্তর নেই। ‘‘তৃণমূলের শীর্ষ স্তর থেকেই আমাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।’’— এ দিন দাবি করেছেন তিনি।
বিষয়টি জানতে এ দিন রাতে টিএমসিপি’র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। প্রশ্ন শুনে তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওই সময় আমি এই পদে ছিলাম না। তাই কোনও মন্তব্য করব না।’’ পরে যদিও অশোকবাবু বলেন, ‘‘ওর (তুষার) বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ঠিকই। তবে এটাও সত্যি যে, স্বপনকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তুষারই।’’ তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কোনও অপরাধকেই প্রশ্রয় দেয় না বলে অশোকবাবু জানিয়ে দেন। তুষারও এ দিন দাবি করেছেন, স্বপন খুনে তাঁর কোনও ভূমিকা নেই। ‘‘আমি-ই তো ওকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম!
সেই কাজের জন্যই দলীয় নেতৃত্ব আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। আমিও চাই, খুনিদের শাস্তি হোক।’’— বলেছেন তিনি।
এ সব শুনে অবশ্য রেবাদেবী সান্ত্বনা পাচ্ছেন না। বারবার প্রশ্ন করছেন, ‘‘এই কি চলবে? কীসের ভরসায় মা-বাবা ছেলেকে পড়াশোনা করতে পাঠাবে?’’ আড়গোড়ের আন্দুল রোডের পাশে স্বপনদের দোতলা বাড়ি। ঠাকুর্দা, মা-বাবা ও দুই দাদার সঙ্গে হইচই করে দিন কাটত স্বপনের। দোতলার একটা ঘর জুড়ে আজও ছড়িয়ে তাঁর স্মৃতি। ছেলে চলে যাওয়ার পরে মা কার্যত দোতলায় ওঠা ছেড়েই দিয়েছেন।
তবে এখনও আশা ছাড়েননি। টিভি’র পর্দায় চোখ রেখে রেবাদেবী অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘‘ছেলেকে তো ফিরে পাব না। মারা যাওয়ার আগে যেন দেখতে পাই, ওর খুনিরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।’’
টিভির পর্দায় তখনও সবংয়ের ছাত্র খুনের খবরটাই চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy