Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
স্ট্রিপ-সন এ লুমিয়ের চালু হচ্ছে বছরের শুরুতেই

হাজারদুয়ারিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে মতিঝিল

ঐতিহাসিক হাজারদুয়ারি বনাম প্রকৃতি তীর্থ মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন মরসুমের শুরুতেই পর্যটক সংখ্যার দিক থেকে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও সংগ্রহশালাকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হাজারদুয়ারি মিউজিয়াম ঘুরে দেখেছেন ১ লক্ষ ৮৮ হাজার ৬৩ জন পর্যটক।

শুভাশিস সৈয়দ
মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৪:৫৩
Share: Save:

ঐতিহাসিক হাজারদুয়ারি বনাম প্রকৃতি তীর্থ মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন মরসুমের শুরুতেই পর্যটক সংখ্যার দিক থেকে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও সংগ্রহশালাকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র।

গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হাজারদুয়ারি মিউজিয়াম ঘুরে দেখেছেন ১ লক্ষ ৮৮ হাজার ৬৩ জন পর্যটক। সেখানে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা ২ লক্ষ ৬ হাজার ৩৪১ জন। ওই দর্শক সংখ্যা প্রমাণ করে দিচ্ছে খুব দ্রুত মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ফলে এ বারের পর্যটন মরসুমে পর্যটকদের কাছে মতিঝিলকে আরও আকর্ষণীয় করতে তুলতে জেলাপ্রশাসনও উদ্যোগী হয়েছে। তার মধ্যে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্রে নতুন বছরের শুরুতেই চালু হতে চলেছে সন এ লুমিয়ের বা শব্দ ও আলোয় এই ঐতিহাসিক সৌধের ইতিহাস কথন। মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও জানান, ‘‘সাগরদিঘির সভা থেকে ওই লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষের দীর্ঘ দিনের চাহিদা ছিল সন এ লুমিয়ের-এর। বাম আমলে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও সংগ্রহশালাকে ঘিরে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড চালু করতে উদ্যোগ শুরু হয়। কিন্তু প্রশাসন উদ্যোগী না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত চালু হয়নি। এদিকে সন্ধ্যার পরে মুর্শিদাবাদ শহরে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের কোনও ব্যবস্থাও নেই। ফলে সন্ধ্যা নামতেই পর্যটকদের হোটেলের ঘরে ঢুকে টিভি দেখে অলস সময় কাটানো ছাড়া কোনও গতি ছিল না। এখন সেই দুঃখ ঘুচল।

সেই সঙ্গে এই ব্যবস্থার ফলে পর্যটকেরা এ বার এই ঐতিবাসিক স্থানগুলির প্রকৃত ইতিহাসও জানতে পারবেন। এটা একটা বড় অসুবিধা ছিল। সরকারি ভাবে এই ঐতিহাসিক সৌধগুলির পরিচয় পাওয়ার কোনও ব্যবস্থাই প্রায় নেই। ভরসা ছিল কেবল স্থানীয় গাইডেরা। কিন্তু গাইডদেরও প্রশিক্ষণের কোনও ব্যবস্থা সে ভাবে নেই। অনেকে গাইড নিতেনও না। নিজেরাই দেখতে যেতেন। এখন বিদ্বজ্জনদের পরামর্শ নিয়ে তৈরি লাইট অ্যান্ড এক্ষেত্রে ইতিহাসের ঠিক পাঠ পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন পর্যটকেরা। ইতিবাসবিদ খাজিম আহমেদ বলেন, ‘‘কেবল সৌধটি দেখাই যথেষ্ট নয়। ইতিহাসটি জানাও খুব জরুরি। কিন্তু স্থানীয় গাইডরা প্রশিক্ষিত নন। তাই এ বার সাউন্ড অ্যান্ড লাইটের ব্যবস্থা হওয়ায় পর্যটকদের ভ্রমণ অনেক বেশি আকর্ষণীয় হবে।’’ স্থানীয় গাইড সঞ্জয় দাস বলেন, ‘‘আমাদের প্রশিক্ষণ নেই ঠিকই। কিন্তু আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি ঠিক ইতিহাসটিই মানুষকে বলতে। এ বার সাউন্ড অ্যান্ড লাইট হওয়ার পরে মানুষ ইতিহাসের কথা শুনবেন। তারপরে, আমাদের আশা, আমাদের কাছে আরও কিছু জানতেও চাইবেন।’’

সেপ্টেম্বর ৬৩ হাজার ২০০

অক্টোবর ৭৭ হাজার ১২৩

নভেম্বর ৪৭ হাজার ৭৪০

ডিসেম্বর প্রায় ২৫ হাজার (এখনও পর্যন্ত)

সেপ্টেম্বর: ৭২ হাজার ২৫৭ জন

অক্টোবর: ৬২ হাজার ২৩৩ জন

নভেম্বর: ৭১ হাজার ৮৫১ জন

ডিসেম্বর ৩১ হাজার ৪৪ জন (এখনও পর্যন্ত)

জেলাপ্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কলকাতার এক বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলাপ্রশাসন ওই সাউন্ড অ্যান্ড লাইট তৈরি করিয়েছে। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিক্রম ঘোষ। এ ছাড়াও কন্ঠ দিয়েছেন দীপঙ্কর দে, রজতাভ দত্ত, শাশ্বত চক্রবর্তী, অরিন্দম শীল, বিদীপ্তা চক্রবর্তীর মতো নাটক ও সিনেমা ব্যক্তিত্ব। বর্ষবরণের দিন ওই সন এ লুমিয়ের-এর শুভ সূচনা হতে চলেছে।

সেই সঙ্গে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে বহরমপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪৫ আসনের একটি অত্যাধুনিক বাতানুকূল বাস সার্ভিস চালু করছে জেলাপ্রশাসন। টাটা কোম্পানির ঝাঁ চকচকে ওই বাস চালুর আগে সংস্থার ইঞ্জিনিয়াররা সরজমিনে খতিয়ে দেখে গিয়েছেন। কেননা, নবাবি আমলের শহর মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন রাস্তায় বিশাল মাপের ওই বাস যাতায়াত করতে যাতে কোনও অসুবিধের মুখে পড়তে না হয়, তা খতিয়ে দেখার পরেই রুট ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। জেলাশাসক বলেন, বহরমপুর থেকে পর্যটকদের তুলে নিয়ে গিয়ে হাজারদুয়ারি-সহ মুর্শিদাবাদ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যে সব পুরাসম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে, তা ঘুরিয়ে দেখানোর পরে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সহ সাউন্ড অ্যান্ড লাইট দেখে ওই বাসে পর্যটকরা ফের বহরমপুরে ফিরে আসতে পারবেন। এ জন্য পর্যটকদের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হবে, তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে গাড়ি ভাড়া বাবদ যে অর্থ খরচ হয়ে থাকে, তার থেকে অনেক কম টাকা পড়বে।

শীতের পরশ পড়তেই মতিঝিল দিঘিতে পরিযায়ী বিভিন্ন পাখির আনাগোনাও শুরু হয়েছে। প্রায় ৬ একর জায়গা জুড়ে ওই পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ‘গলফ্ কার্ট’। পর্যটন মরসুম উপলক্ষে পর্যটকদের স্বার্থে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে ১০টি স্টল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘বিশ্ব বাংলা হাট’। সেখানে শোলা, বাঁশ ও পাটের হাতের তৈরি যাবতীয় উপকরণ থেকে সিল্ক ও মসলিন শাড়ি বিক্রি হচ্ছে।

‘হাজারদুয়ারি ও লাগোয়া অন্য ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিগুলো দেখার পরে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছতেই মনে হল কোনও স্বপ্নপূরীতে এসে গিয়েছি’—জানালেন দক্ষিণ কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা সুমা বিশ্বাস। সুমাদেবী-সহ ৬ জন মহিলা মুর্শিদাবাদ বেড়াতে এসেছেন। সুমাদেবীর কথায়, ‘‘হাজারদুয়ারি প্রাসাদের চারপাশের পরিবেশ নোংরা আবর্জনায় ভরা। বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখতে যাওযার রাস্তাঘাটের হালও ভাল নয়। রাস্তা খানা-খন্দে ভরা। ওই সব দেখে কিছুটা হলেও হতাশ হই। কিন্তু সমস্ত মন খারাপ মতিঝিলে ঢুকতেই উধাও হয়ে যায়।’’

মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র পর্যটন মানচিত্রে মুর্শিদাবাদ জেলাকে মর্যাদা জোগালেও খামতিও কিন্তু কম নেই। মুর্শিদাবাদ জেলা চেম্বার অফ কমার্সের যুগ্ম সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘গত ২০ নভেম্বর পর্যটন মরসুমের আগে নিয়ম করে প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার ক্ষেত্রে কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না।’’ ইতিহাস গবেষক তথা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রবীণ রামপ্রসাদ পাল জানান, ‘‘পর্যটন উন্নয়ন নিয়ে কম কথা হচ্ছে না। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে কি? উন্নয়নের এমন কোনও একটি দিক নেই যা পর্যটনদের সঠিক পরিষেবার দিশা দেখাতে পারে। পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকটি এখানে উপেক্ষিত।’’ নোংরা রাস্তাঘাট, ঘোড়ার মল-মূত্র যত্রতত্র পড়ে থাকা বহিরাগত পর্যটকদের কাছে জেলার পর্যটন শিল্প সম্বন্ধে ভাল বার্তা বহণ করছে কি? প্রশ্ন মুর্শিদাবাদের নাগরিকদেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE