Advertisement
E-Paper

ঝলসে গিয়েও বাড়ি ফিরতেই চেয়েছিল মৌ

অ্যাসিডে ফুসফুস পর্যন্ত ঝলসে গিয়েছিল মেয়েটির। তবু সে যুঝে গিয়েছে এক সপ্তাহ। পুলিশের কাছে বয়ান দিয়েছে। কে অ্যাসিড ছুড়ে থাকতে পারে, তার চেহারার বর্ণনা হাসপাতালে শুয়েই সে দিয়েছিল পুলিশকে।

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৩৬
মৌ রজক।

মৌ রজক।

অ্যাসিডে ফুসফুস পর্যন্ত ঝলসে গিয়েছিল মেয়েটির।

তবু সে যুঝে গিয়েছে এক সপ্তাহ। পুলিশের কাছে বয়ান দিয়েছে। কে অ্যাসিড ছুড়ে থাকতে পারে, তার চেহারার বর্ণনা হাসপাতালে শুয়েই সে দিয়েছিল পুলিশকে।

কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। মঙ্গলবার আলো ফোটার আগেই কলকাতায় এনআরএসে মারা গেল নদিয়ার হাঁসখালিতে অ্যাসিডে আক্রান্ত মৌ রজক।

অ্যাসিড হামলার সংখ্যার নিরিখে ভারত এই মুহর্তে দুনিয়ায় শীর্ষস্থানে। প্রতি বছরই সংখ্যাটা লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু গত বছরেই আক্রান্ত হন সাড়ে তিনশো জন, যাঁদের প্রায় সকলেই মহিলা। কিন্তু মৃত্যুর ঘটনা তুলনায় কম। তিন বছর আগে মুম্বইয়ের বান্দ্রা স্টেশনে অ্যাসিড হামলায় মারা গিয়েছিলেন প্রীতি রাঠি। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী মৌ সেই তালিকাতেই ঢুকে পড়লেন।

নবমীর রাতে দরজা আর টিনের চালের ফাঁক দিয়ে বিছানায় ছুড়ে দেওয়া অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছিলেন মৌয়ের মা-ও। এনআরএস তাঁকে আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি মেয়েকে আঁকড়ে হাসপাতালেই পড়ে ছিলেন। সেখানে বসেই চোয়াল শক্ত করে তিনি শুধু বললেন, ‘‘একটা ছেলে সব শেষ করে দিল!’’

সেই ‘ছেলে’, তিন সন্তানের বাবা ইমান শেখকে নদিয়া পুলিশ ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে। নির্মল সাহা নামে কৃষ্ণনগরের যে ব্যাটারির দোকানদার তাকে সালফিউরিক অ্যাসিড বিক্রি করেছিল, তাকেও পাকড়াও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে জ্বালা জুড়োচ্ছে না মৌয়ের বাড়ির লোকেদের।

মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে বাড়িতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা ভোলানাথ রজক। বারবার মনে পড়তে থাকে, কী ভাবে জ্বালাপোড়ায় ছটফট করতে-করতে সে রাতে কলতলায় ছুটেছিল মেয়ে আর বৌ। তিনি শুয়েছিলেন অন্য চৌকিতে। তাই বেঁচে যান। এ দিন তিনি আর কলকাতায় যেতে পারেননি। সন্ধ্যায় হাঁসখালির গাজনা গ্রামে অ্যাসিডে পোড়া বিছানায় বসে মেয়ের দেহের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে প্রায় ডুকরে ওঠেন তিনি, ‘‘কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার মাসুল দিতে হল আমার মেয়েকে। ওর মারও প্রাণ যেতে পারত। কী ভাবে এখন বাঁচব?’’

বোনের মৃতদেহ নিতে সকালেই এনআরএসে পৌঁছে গিয়েছিলেন মৌয়ের মেজদা সঞ্জয় রজক। মর্গে যখন ময়নাতদন্ত চলছে, বাইরে বসে চোখ মুছছেন সঞ্জয়। মায়ের মনে পড়ছে— ‘‘রাতে মেয়ে বলেছিল, মা কাল তো দশমী। এ বার কিন্তু আমি একাই নাড়ু বানাব। তুমি এক বারও খুন্তিতে হাত দিতে পারবে না।’’

অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যে বিশেষ ধারা ২০১৩ থেকে যুক্ত হয়েছে, সেই ৩২৬ ধারায় ইতিমধ্যেই ইমান শেখ ও অ্যাসিড বিক্রেতা নির্মল সাহার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম সাজা দশ বছর কারাদণ্ড। কিন্তু মৌ মারা যাওয়ায় এ বার খুনের ধারাও যুক্ত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্তের প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। প্রীতি রাঠি হত্যায় অভিযুক্ত অঙ্কুর পানবারকে গত সেপ্টেম্বরেই প্রাণদণ্ড দিয়েছে মহারাষ্ট্রের বিশেষ মহিলা আদালত। যদিও মামলাটি উচ্চতর আদালতে গড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কী হবে?

নদিয়া জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, ইমানের পাশাপাশি নির্মলের নামেও এরপর চোদ্দোর পাতায় খুন বা খুনের চক্রান্তে জড়িত থাকার মামলা রুজু হবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। কেন, কী উদ্দেশ্যে, কোন নিয়ম মেনে তিনি ইমানকে অ্যাসিড জুগিয়েছিলেন, তার সদুত্তর এখনও মেলেনি। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “অ্যাসিড বিক্রেতার ভূমিকা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তদন্ত চলছে। যেমনটা জানা যাবে, সেই মতো ধারা দেওয়া হবে।”

বোনের মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেওয়ার আগেও সঞ্জয় ভাবতে পারছিলেন না, সব শেষ। ধরা গলায় বলেন, ‘‘হাসপাতালে শুয়েও কখনও জ্বালা-যন্ত্রণার কথা বলত না বোন, জানেন তো! শুধু বলত, আমি বাড়ি ফিরতে চাই। আমি বাঁচব তো?’’

খুন বা খুনের চক্রান্তে জড়িত থাকার মামলা হবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। কেন, কী উদ্দেশ্যে, কোন নিয়ম মেনে তিনি ইমানকে অ্যাসিড জুগিয়েছিলেন, তার সদুত্তর মেলেনি। পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “অ্যাসিড বিক্রেতার ভূমিকা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। যেমনটা জানা যাবে, সেই মতো ধারা দেওয়া হবে।”

বোনের মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেওয়ার আগেও সঞ্জয় ভাবতে পারছিলেন না, সব শেষ। ধরা গলায় বলেন, ‘‘হাসপাতালে শুয়েও কখনও জ্বালা-যন্ত্রণার কথা বলত না বোন, জানেন তো! শুধু বলত, আমি বাড়ি ফিরতে চাই। আমি বাঁচব তো?’’

Acid attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy