Advertisement
E-Paper

প্রতিবাদের ছবি আঁকে মৌসুমীর মেয়ে

চার দশক আগের বড় বিলের চেহারাটা এখনও পাল্টায়নি। বিলের চরে দাঁড়িয়ে এখনও গর্বের হাসি হাসেন গ্রামের যুবক। ‘‘এখানেই ‘সওদাগর’-এ অমিতাভ-নূতনের ঘর তোলা হয়েছিল।’’ বিল লাগোয়া ভেড়ির ফাঁকে বাঁধটা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ওখানেই পদ্মা খন্নার ছুটে-ছুটে যাওয়ার সিনটা ছিল।’’ তার পরই মুখটা গম্ভীর হয়ে যায় তাঁর। বিলের পিছনে খানিক দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘‘মাটিয়াগাছা গ্রামের দিকটাতেই আনসার আলির বাড়ি। ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ও-ই।’’

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৫ ০৪:২৩
ছবি আঁকছে মৌসুমী কয়ালের মেয়ে সুইটি। ছবি: সুমন বল্লভ

ছবি আঁকছে মৌসুমী কয়ালের মেয়ে সুইটি। ছবি: সুমন বল্লভ

চার দশক আগের বড় বিলের চেহারাটা এখনও পাল্টায়নি।

বিলের চরে দাঁড়িয়ে এখনও গর্বের হাসি হাসেন গ্রামের যুবক। ‘‘এখানেই ‘সওদাগর’-এ অমিতাভ-নূতনের ঘর তোলা হয়েছিল।’’ বিল লাগোয়া ভেড়ির ফাঁকে বাঁধটা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ওখানেই পদ্মা খন্নার ছুটে-ছুটে যাওয়ার সিনটা ছিল।’’ তার পরই মুখটা গম্ভীর হয়ে যায় তাঁর। বিলের পিছনে খানিক দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘‘মাটিয়াগাছা গ্রামের দিকটাতেই আনসার আলির বাড়ি। ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ও-ই।’’

ঠিকই তো। উত্তম-সুচিত্রার ‘গৃহদাহ’ বা অমিতাভের ‘সওদাগর’-এর লোকেশন হওয়ার সুবাদে কামদুনি কখনও খবরের শিরোনাম হয়নি। ঠিক দু’বছর আগে ধর্ষণ-কাণ্ডের দগদগে স্মৃতিই কামদুনির পরিচয়।

ক্লাস ফোরের প়ড়ুয়া বছর নয়েকের মেয়েটাই যেমন! কামদুনির ‘প্রতিবাদী মুখ’ মৌসুমী কয়ালের মেয়ে সুইটি আর বাড়ির পাশের তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা আঁকে না। এ দিন দুপুরে সে আঁকছিল প্রতিবাদের ছবি। তারই মতো ফ্রক-পরা মেয়েদের হাতে-হাতে ধরা পোস্টার। কী লেখা আছে ওতে? লাজুক হেসে ইচ্ছে মতো রঙে সে-সব ভরাট করে দেয় মেয়েটি। বলে, ‘‘মায়েদের আন্দোলনের ছবি।’’ মা কোথায়? এ তো বাচ্চা মেয়েরা! ‘‘মায়েদের ছবি আঁকা অনেক বেশি শক্ত!’’ সোজাসুজি জবাব দেয় সুইটি। ‘‘গ্রামের একটা দিদি মারা গিয়েছিল তো, তাই মায়েরা আন্দোলনে নেমেছে!’’ মা-বাবাকে অবাক করেই বলে ওঠে সে। ‘‘আমিও মায়ের মতো হব’’, বলতেও দু’বার ভাবে না।

সুইটির মা মৌসুমী বা পাশের বাড়ির টুম্পামাসি (টুম্পা কয়াল) এখন এ রাজ্যে যে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদে সামিল হন। ছেলের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মধ্যমগ্রামের যে নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে সম্প্রতি, শনিবারই তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন দু’জনে। মুখ্যমন্ত্রীর মুখে-মুখে তর্ক করে সেই যে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তার পরে ওঁরা ফিরে তাকাননি। শাসক দলের তরফে দুই প্রতিবাদী নারীর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু ওঁরা মিটমাটে রাজি হননি। তবে দু’বছর পরের কামদুনিতে মৌসুমী-টুম্পারা এখন অনেকটা সংখ্যালঘু। টুম্পার কথায়, ‘‘অনেক ধরনের চাপ রয়েছে! তাই অনেকেই সামনে আসতে সাহস করেন না। কিন্তু মনে-মনে আমাদের পাশেই আছেন বেশির ভাগ মানুষ।’’ মৌসুমী হেসে ফেলেন, ‘‘আমাদের জন্যও বাড়ির লোকে কম ভয় পায়নি! তবু এখনও মাথা উঁচু রাখতে পেরেছি।’’

কামদুনির বাতাসে ঘুরপাক খায় শাসক দলের গোটা গ্রামকে কিনে ফেলার কাহিনি। অভিযোগ, শাসকের বিরুদ্ধে যারাই গিয়েছেন, ভেড়িতে তাদের ভাগের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পার্টির লোক! একঘরে করা হয়েছে মার্কা-মারা বিরোধীদের। প্রতিবাদী-মঞ্চের পাল্টা শান্তি কমিটি গড়ে কামদুনিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা শান্তি কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সনাতন ঘোষ ওরফে সোনা অবশ্য প্রতিবাদীদের উপরে জুলুমের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন। গ্রামের মৃতা নারীর তুতো ভাই দীপঙ্কর ঘোষ ওরফে মিস্টারকে পাশে নিয়ে ফলাও করে বললেন, ‘‘সবাই আমাদের পাশে!’’

কামদুনি বা আশপাশের গ্রামে একটু কথা বললেই কিন্তু টের পাওয়া যায় ক্ষোভের পারদ। নিঝুম দুপুরে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছিল যেখানে, সেই সিমেন্ট কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে রাগ উগরে দেন পাশের কৃষ্ণমাটি গ্রামের যুবক ওয়াহিদ আলি, ‘‘দু’বছরেও কোনও সাজা হল না কারও।’’ রাস্তার ধারের বাসিন্দা বাবুরাম মন্ডল বলেন, পাকা রাস্তাটুকুও এত দিনে হল না। মৃতা তরুণী যেখানে পড়তেন, সেই ডিরোজিও কলেজের এক দল ছাত্র বলে ওঠেন, ‘‘কেউ কিছু করল না।’’

মনে পড়ল, মৌসুমি-টুম্পাদের বলা কথাটা। ‘‘মানুষের চুপ করে থাকাটা সাময়িক। সময় হলেই একদিন ফেটে পড়বে।’’

kamuduni rape police mousumi koyal Riju Basu uttam kumar suchitra sen mamata bandopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy