Advertisement
E-Paper

দল ভাঙানোর ‘জনক’ মুকুলের বিধায়কপদ গেল ‘উত্তরসূরি’ শুভেন্দুর করা মামলায়! বৃত্ত কি সম্পূর্ণ? না কি নতুন বৃত্তের শুরু

হাই কোর্টের মুকুল-রায় ঘোষণা হতেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, সুমন কাঞ্জিলাল, হরকালী পতিহার, বাইরন বিশ্বাস, তাপসী মণ্ডলদের ক্ষেত্রে কী হবে? যাঁরা প্রত্যেকে হয় বিজেপি অথবা কংগ্রেসের টিকিটে জিতে তৃণমূলে শামিল হয়েছেন।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৫ ১২:১৫
Mukul Roy MLA post dismissed in the case filed by Suvendu Adhikari, is the circle complete in Bengal politics

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দায়ের করা মামলায় বিধায়কপদ খারিজ বিজেপির টিকিটে জেতা মুকুল রায়ের। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সমাপতন? না কি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল? না কি নতুন বৃত্তের সূচনা?

একদা তৃণমূলের ‘দ্বিতীয় নেতা’ মুকুল রায়ের বিধায়কপদ বৃহস্পতিবার খারিজ করে দিয়েছে হাই কোর্ট। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রায় অসাড় মুকুল হয়তো জানেনও না যে তাঁর বিধায়কপদ খারিজ হয়ে গিয়েছে! কিন্তু যাঁর দায়ের করা মামলায় পদ খোয়ালেন মুকুল, তিনিও ছিলেন তৃণমূলের বলিষ্ঠ নেতা, সাংসদ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের একাধিক দফতরের মন্ত্রী, একাধিক জেলার সাংগঠনিক পর্যবেক্ষক— শুভেন্দু অধিকারী।

২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বঙ্গ রাজনীতিতে দলবদলের সংস্কৃতির শুরু। গোড়ার দিকে মুকুলই ছিলেন দল ভাঙানোর ‘জনক’। তার পরে মালদহ, মুর্শিদাবাদ-সহ একাধিক জেলায় সেই ‘মুকুলধারা’ অব্যাহত রেখেছিলেন শুভেন্দু। যে কারণে দলবদলের সংস্কৃতির সমালোচনা করতে গিয়ে বাম-কংগ্রেস নেতারা প্রায়ই বলেন, মুকুল ছিলেন ‘স্রষ্টা’। আর শুভেন্দু তাঁর ‘উত্তরসূরি’। একটা সময়ে বিজেপি-ও একই কথা বলত। কিন্তু এখন তাদের সে কথা বলার বাস্তবতা নেই।

ঘটনাচক্রে, সেই শুভেন্দুরই দায়ের করা মামলায় দলত্যাগ বিরোধী আইনে বিধায়কপদ খোয়ালেন মুকুল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে মুকুল জিতেছিলেন বিজেপির টিকিটে। শুভেন্দুও সেই ভোটের আগে তৃণমূল, মন্ত্রিত্ব, বিধায়কপদ ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে নন্দীগ্রামে হারিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি হয়ে যান বিরোধী দলনেতা। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের মাসখানেকের মধ্যেই মুকুল তৃণমূলে ফেরেন। এ হেন মুকুলকে রাজ্য বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করে দেওয়া হয়। রীতি অনুযায়ী যে পদে নিয়োগ করা হয় বিরোধীদলের কাউকে। ঘটনাপরম্পরা শুভেন্দুকে ক্রমে মামলা করার দিকে এগিয়ে দেয়। কারণ, শুভেন্দু দাবি করেছিলেন, মুকুলের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইনে অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অভিযোগ জানিয়েও তিনি কোনও সুরাহা পাননি। মুকুলের বিধায়কপদ খারিজের পরে হাই কোর্টের সেই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছেন শুভেন্দু। বলেছেন, সংবিধানের জয় হল।

দল ভাঙানোর ‘জনক’ মুকুল একান্ত আলোচনায় একটি তত্ত্ব বলতেন— নেতা তো মঙ্গলগ্রহ থেকে আসে না। নেতারা থাকে এই পৃথিবীতেই। এ দলে বা সে দলে। সেই নেতাদের নিয়ে এলে অপরাধ কোথায়? মুকুল এর মধ্যে কোনও ‘অনৈতিকতা’ দেখতেন না। বস্তুত, তিনি বলতেন, জানালা-দরজা খুলে রাখা উচিত। তৃণমূলের অন্দরে কেউ কেউ একটা সময়ে তার বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মুকুলের তত্ত্ব বদলায়নি। শুভেন্দুও যখন তৃণমূলের নেতা হিসাবে দলবদল করাতেন, তখন তিনিও খুব আদর্শ মেনে, জনপ্রতিনিধিদের পদত্যাগ করানোর পর দলে শামিল করতেন বলে শোনা যায় না। কিন্তু ব্যক্তি শুভেন্দু ‘নৈতিকতা’ মেনেই দলবদল করেছিলেন। মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা এবং নিরাপত্তা ছেড়ে দেওয়ার পরে বিধায়কপদও ছেড়ে দিয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যোগ দিয়েছিলেন পদ্মশিবিরে। পক্ষান্তরে, মুকুল ‘উদারপন্থী’। তিনি মনে করতেন না জনপ্রতিধিদের পদত্যাগ করেই দলবদল করা উচিত। তিনি নিজেও জনপ্রতিনিধির পদে ইস্তফা দিয়ে দল বদলাননি।

শুভেন্দুর মামলায় মুকুলের বিধায়কপদ যাওয়াকে অনেকেই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন। প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি অধীর চৌধুরী যেমন বলছেন, ‘‘বাংলায় আয়া রাম-গয়া রামের সংস্কৃতি ছিল না। এর নেত্রী মমতা। তিনি এটা শুরু করিয়েছিলেন মুকুলকে দিয়ে। পরে শুভেন্দু সেই কাজ করতেন।’’ অধীর এই দলবদলের সংস্কৃতিকে আক্রমণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি যা করে, এখানে তৃণমূলও তা-ই।’’ বঙ্গে কি তা হলে বৃত্ত সম্পূর্ণ হল? অধীর তা মনে করছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘যত দিন তৃণমূল-বিজেপি এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে তত দিন নতুন নতুন বৃত্ত তৈরি হতে থাকবে।’’

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘মুকুল রায় যে সংস্কৃতিকে নিউ নর্মাল করেছিলেন, তাকে গতি দিয়েছিলেন শুভেন্দু। দল ভাঙানোর মেলা বসিয়েছিলেন। ব্যবহার করেছিলেন আইপিএস, আইএএসদের। দু'জনেই একই স্কুলের পড়ুয়া।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘শুভেন্দুও দলবদলু। মুকুলও তাই। একই গোত্রের দু'জনের একজন মামলা করেছিলেন, অন্য জন তার জেরে পদ খোয়ালেন। পুরনো বৃত্ত ঘিরে তৈরি হল নতুন বৃত্ত।’’

প্রত্যাশিত ভাবেই বিজেপি বিষয়টিকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘যে কাজ করার কথা ছিল বিধানসভার স্পিকারের, তা করতে হয়েছে কোর্টকে।’’ আর দলবদলের ‘স্রষ্টা’ এবং ‘উত্তরসূরি’ তত্ত্ব? শমীক বলছেন, ‘‘এটা কোনও ব্যক্তির বিষয় নয়। (শুভেন্দু) তৃণমূলে যখন ছিলেন তখন তাদের মতো কাজ করতেন। এখন বিজেপির মতো করেন।’’

হাই কোর্টের ‘মুকুল-রায়’ ঘোষণা হতেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে সুমন কাঞ্জিলাল, হরকালী পতিহার, বাইরন বিশ্বাস, তাপসী মণ্ডলদের নিয়ে। যাঁরা প্রত্যেকে হয় বিজেপি অথবা কংগ্রেসের টিকিটে জিতে তৃণমূলে পরে শামিল হয়েছেন। এঁদের মধ্যে আবার হলদিয়ার তাপসী ‘অনন্যা’। সিপিএম বিধায়ক থাকাকালীন তাপসী শুভেন্দুর সঙ্গে গিয়ে ২০২০ সালে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি বিধায়কপদ ছেড়ে গিয়েছিলেন এমন নয়। ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে ফের জেতেন হলদিয়ায়। কয়েক মাস আগে তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তবে এ বারও ইস্তফার রাস্তায় হাঁটেননি।

গত দেড় দশক ধরে দলবদলের যে সংস্কৃতি রাজ্য রাজনীতিতে কার্যত স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে, মুকুল-রায়ের পরে তা কি থমকে যাবে? রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, এখনই তা বলা যায় না। কারণ, দল ভাঙানো ‘শক্তিপ্রদর্শনের মাধ্যম’ হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে তা থেমে যাওয়ার নয়। তবে মানুষের ভোটে জিতে জনপ্রতিনিধিরা আচমকা দলবদল করতে গেলে হয়তো এর পরে দু’বার ভাববেন। কারণ, মুকুলের পদ খোয়ানো পরিষদীয় রাজনীতিতে ‘দৃষ্টান্ত’ হয়ে রইল।

Mukul Roy Suvendu Adhikari TMC BJP High Court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy