রঞ্জি ম্যাচ দেখতে ইডেন গার্ডেন্সে মুকুল রায়। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।
রাত পোহালেই সিবিআই তদন্তের মুখোমুখি হবেন তিনি। কিন্তু সিবিআই দফতরে পা দেওয়ার আগেও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার সঙ্গে সংঘাতের পথে যেতে চাইছেন না তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। বরং, সময় বার করে চলে যাচ্ছেন বাংলা ক্রিকেট দলের রঞ্জি ম্যাচ দেখতে! তদন্তকারীদের সামনাসামনি হওয়ার আগে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর এমন শান্ত-শীতল মনোভাব তাঁর দলের রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে! আতঙ্কের প্রহর গুনছে তৃণমূল! শাসক দলের অন্দরে প্রবল জল্পনা, তা হলে কি সিবিআইয়ের কাছে গিয়ে কার সম্পর্কে কতটা মুখ খুলতে হবে, তার নকশা ছকে নিয়েছেন এই সে দিন পর্যন্ত দলে তৃণমূল নেত্রীর ডান হাত?
সল্টলেকে সিবিআই দফতরে আজ, শুক্রবার সকাল ১১টা নাগাদ হাজিরা দিতে যাওয়ার কথা মুকুলের। তার আগের দিন, বৃহস্পতিবার বেশির ভাগ সময়টাই মুকুল কাটিয়েছেন নিজাম প্যালেসে তাঁর নিজের দফতরে। সিবিআইয়ের তলব পাওয়ার পরে আগে কয়েক বার সময় নিয়েছেন। কিন্তু এ বার নির্ধারিত দিনেই সিবিআই দফতরে যাবেন বলে কয়েক দিন ধরে বলে আসছেন। সেই সুর বজায় রেখেছেন এ দিনও। আর সেই সঙ্গেই ফের দাবি করেছেন, “আমি কোনও অন্যায়, অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত নই। সিবিআইকে তদন্তে আমি সমস্ত রকম সহযোগিতা করব।” নিজের মুখে যেমন সহযোগিতার কথা বলছেন, তেমনই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক চাইছেন তৃণমূলের আম নেতা-কর্মীরা যেন তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালীন অসহযোগিতা না করেন।
আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য, নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়ে মুকুল গিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেন্সে বাংলা ও রেলের রঞ্জি ম্যাচ দেখতে! মুকুলের কথায়, “বাংলার ছেলেদের উৎসাহিত করতে গিয়েছিলাম। ওদের এখন ‘ব্যাড প্যাচ’ যাচ্ছে। ওদের বলেছি, লড়াই করে এই অবস্থা কাটাতে হবে।” রাজ্যে যে রাজনৈতিক দল লাগাতার ‘ব্যাড প্যাচে’র মধ্যেই পড়ে আছে, তাদের শীর্ষ নেতা সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের কাছে যাওয়ার আগে বাংলার ক্রিকেটারদের উৎসাহ দিতে চলে যাচ্ছেন! মুকুলের এমন বরফ-ঠান্ডা মানসকিতা থেকেই অশনি সঙ্কেত পড়ে নিয়ে শীতল স্রোত নামতে শুরু করেছে শাসক দলের শিরদাঁড়ায়!
বস্তুত, সিবিআইয়ের তলব পেয়ে তাঁর দলেরই সহকর্মী এবং রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্রের পথে হাঁটতে চাইছেন না মুকুল। নিজের অনুগামীদের কাছে তাঁর এই মনোভাব স্পষ্টও করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে মুকুলের আবেদন, জেরা চলাকালীন বা তার পরে অপ্রিয় কিছু (গ্রেফতার) ঘটে গেলেও কেউ যেন অশান্তি সৃষ্টি না করে। সিবিআই তদন্তের স্বার্থে কাউকে ডাকতেই পারে। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা মুকুলের কাছে ‘অনভিপ্রেত’। দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে সিবিআই তদন্তের প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই পথে নেমেছেন, সেখানে মুকুল তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সরাসরি তদন্তে বাধা সৃষ্টির বিপক্ষে (ঠিক যে সুর শোনা গিয়েছিল ক’দিন আগে তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের গলায়)। মুকুলের মতে, কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের প্রতিবাদ করলেও তা করা উচিত গণ্ডি মেনে। এমনকী, সারদা-কাণ্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার বা শাসক দলের পাল্টা মামলারও বিরোধী ছিলেন রাজ্যসভার এই সাংসদ।
এখন শেষ প্রহরে মুকুলের মনোভাব দেখে দলেরই একাংশের প্রশ্ন, সচেতন ভাবেই কি তিনি সিবিআইয়ের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে চাইছেন? দলনেত্রীর এত কাছের নেতা তিনি যে, মুকুলকে ডেকে তৃণমূলের আরও উপর তলা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবেন তদন্তকারীরা এই নিয়ে বিশেষ সংশয় শাসক দলেও কারও নেই। বিশেষত, ডেলো পাহাড়ের বাংলোয় সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে বৈঠক এবং তৃণমূল নেত্রী রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদার চুক্তি এই দুই বিষয়ে মুকুলের করা মন্তব্যই তদন্তকারীদের কাছে হাতিয়ার হতে পারে। দলের মধ্যেই আশঙ্কা ঘোরাফেরা করছে, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মুকুল যদি তদন্তকারীদের সঙ্গে ‘সহযোগিতা’ই করেন, তার পরিণাম তৃণমূলে কোথায় দাঁড়াবে? দলের এক নেতার কথায়, “মুকুলকে দেখে মনে হচ্ছে উনি ধরে নিয়েছেন, সিবিআই ওঁকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতারই করবে। তদন্তকারীদের কাছে উনি কী করবেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন!”
সিবিআই কর্তারাও তথ্য হাতে অপেক্ষায় আছেন, কত দূর সহযোগিতা মুকুল করেন। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “ডেলোর বৈঠক এবং আইআরসিটিসি চুক্তির বিষয়ে মুকুলবাবুর নাড়ি-নক্ষত্র জানেন। দু’টি ক্ষেত্রেই তাঁর সক্রিয় ভূমিকার ব্যাপারে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। আবার দু’টি ঘটনাতেই মুকুলবাবুর দলনেত্রী সরাসরি জড়িত। আমাদের হাতে আসা ওই সব ঘটনার যাবতীয় তথ্যই মুকুলবাবুর কাছ থেকে যাচাই করা হবে।” সারদা-কাণ্ডে ধৃত কুণাল ঘোষ, সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের লিপিবদ্ধ বয়ান থেকে অনেক তথ্য পেয়েছে সিবিআই। মুকুলের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানও লিখিত বয়ান দিয়েছেন। যাবতীয় জায়গা থেকে সংগৃহীত তথ্য মুকুলের সামনে ফেলে তাঁর বক্তব্য জানতে চাওয়া হবে, এমনই ইঙ্গিত মিলছে সিবিআই সূত্রে। তিন জন করে অফিসারের দু’টি দল মুকুলের সঙ্গে কথা বলবেন।
সিজিও দফতরে গিয়ে মুকুল ঠিক কী ভূমিকা নেবেন, তা-ই নিয়ে প্রবল জল্পনার মধ্যেই এ দিন নিজাম প্যালেসে তাঁর অনুগামীদের অনেকে মুকুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী, বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত, শিউলি সাহা, ছাত্র নেতা সুজিত শ্যাম, দলের নেতা প্রবন্ধ রায় প্রমুখ। সকলকেই মুকুল বুঝিয়ে দিয়েছেন, আজ যেন রাস্তাঘাটে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। তৃণমূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের তদন্তের বিরুদ্ধে পথে নেমে আন্দোলন গোড়া থেকেই মেনে নিতে পারেননি মুকুল। দলের কোনও নেতা বা জনপ্রতিনিধিকে অন্যায় ভাবে হেনস্থা করা হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁর আপত্তি ছিল না ঠিকই। কিন্তু মদনের সিবিআই দফতরে যাওয়া বা আদালতে হাজিরার সময়ে যে ধরনের বিক্ষোভ, হল্লা তাঁর অনুগামীরা করেছেন, মুকুল একেবারেই তার পক্ষপাতী ছিলেন না। এ হেন মুকুল স্বয়ং যখন সিবিআইয়ের সামনে যাবেন, সেই সময় তাঁকে নিয়ে জল্পনা স্বভাবতই তুঙ্গে!
শাসক দলের শীর্ষ নেতার হাজিরার আগে বিরোধী ও প্রতারিতদের সংগঠন নিজেদের মতো করে চাপ বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। আলিপুরদুয়ারের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, “এক দিকে বিজেপি বলছে, মকুল ভাগ, মমতা ভাগ! আবার তাদের সাংসদ কীর্তি আজাদ মমতাকে ক্লিন চিট দিচ্ছেন! আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হবে!” কলকাতায় এ দিনই জমায়েত করে ‘অল বেঙ্গল চিট ফান্ড ডিপোজিটর্স অ্যান্ড এজেন্টস ফোরামে’র দাবি, আমানতকারীদের সুদ-সমেত টাকা ফেরতের দায়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্যকে নিতে হবে।
খোদ মুকুল অবশ্য চাপ মানতে নারাজ! সারদা-কাণ্ডে দলের মন্ত্রী-সাংসদ জেলে। তাঁকেও জেরার জন্য ডেকেছে। এর ফলে তৃণমূল কি সঙ্কটে? কপালে তিলক, চোখ-মুখে তেমন কোনও উদ্বেগের চিহ্ন নেই। হাসতে হাসতে মুকুলের জবাব, “দলে ১৯৬ জন বিধায়ক। দলের একটা শক্তিশালী কাঠামো রয়েছে। সঙ্কট আবার কীসের?” সঙ্কটের সময়ে যে নেতারা দলের লাইনের বিরুদ্ধে গিয়ে যে নানা মন্তব্য করেছেন, তার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এ বার রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে মুকুলের উত্তর, “এটা আজ থাক! কালকের দিনটা যাক!”
‘দিনটা’ কেমন যাবে, আসলে সেই উদ্বেগেই আছে গোটা তৃণমূল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy