ঝড়ের বেগে পিছন থেকে ছুটে আসছিল ধুলো।
মোটরবাইক থেকে নেমে ইয়ার আলি শেখ সবে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছেন। বাইকটা পাশে দাঁড় করিয়ে ভাগ্নে হায়দার ঢুকেছেন দোকানে।
গোঁ-ও-ও আওয়াজ তুলে ঝড়টা বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। পিছু-পিছু পাক দিয়ে ধুলো।
কোমরটা টান করতে-করতে সবে আবেদুল ইসলামের সঙ্গে কথা শুরু করেছিলেন ইয়ার আলি। ঝড়ের বেগে একটা বাইককে পাশ ঘেঁষে ছুটে যেতে দেখে তিনি ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
আর তাকাতেই, এক লহমায় বাঁক নিয়ে ফিরল বাইকটা। তিন সওয়ার, মুখ হেলমেটে ঢাকা।
বৃহস্পতিবার, সকাল ৮টা।
ডোমকল থেকে রানিনগরের পথে ন্যাশনাল ইস্কুল মোড়ে তখন না-হক শ’খানেক লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝে অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়েছে।
ফিরতি পথে ছুটে আসছে বাইক। পিছনের সওয়ারি হাত তুলল, হাতের ছ’ঘরা থেকে আকাশে ছিটকে উঠল গুলি— ফট!
ইয়ার আলির ঘাড়ের রোঁয়াগুলো কি দাঁড়িয়ে উঠল? মনে পড়ে গেল কি আগে এক বার ডান কান লক্ষ করে নেমে আসা ছোরার কোপ? মনে পড়ে গেল কি, খবর ছিল...
কয়েক সেকেন্ড মাত্র!
উল্কাগতিতে ধেয়ে এল বাইকটা। ধোঁয়ানো পিস্তল হাতে পিছন থেকে লাফিয়ে নামল সওয়ারি— ফট, ফট, ফট। মাঝখানে বসে থাকা ছোটখাটো চেহারার হাতেও পিস্তল। গুলি ছুটছে — ফট, ফট।
ইয়ার আলি নড়তেও পারেননি। মুখে মাথায় চোখে তিনটে বুলেট। পাশ থেকে কিছু বলতে গিয়েছিলেন আবেদুল। তাঁরও মাথার পাশে বিঁধে যায় একটা বুলেট, চোখ উপড়ে নেয় আর একটা।
ধপ ধপ করে পড়ে যায় দু’টো দেহ। রক্তে ভাসছে।
জনতা পাথর।
সাদা শার্ট-ছাই রঙা ট্রাউজার্স পরা ছেলেটা এ বার হেলমেট খুলে ফেলে। দাড়ি-গোঁফ কামানো সুন্দরপানা মুখ, হাতে ধোঁয়ানো পিস্তল। এ মুখ তল্লাটে অচেনা নয়। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে চেয়ে নিয়ে বুক ঠুকে ছেলেটা বলে— ‘‘এই দেখে রাখ! আমি মিরশাদ। ভাইয়ের খুনের বদলা নিলাম।’’
বলেই লাফিয়ে ওঠে পিছন সিটে। বাইকটা গোঁ-গোঁ করছিলই। এ বার হাওয়ার গতিতে এলাকা ছাড়ে। পিছু-পিছু পাক দিয়ে ছোটে ধুলো।
সেই যে গেল, বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশ আর খোঁজ পায়নি। এক জনকে অবশ্য ধরেছে পুলিশ। তিনি মিরশাদের সম্পর্কিত কাকা, নাম হারুণ শেখ। মামলা রুজু হয়েছে পাঁচ জনের নামে। শেষ খবর পাওয়া ইস্তক, ইসলামপুরের রাস্তায় বেঁকে গিয়েছে বাইক। যা পুলিশ খুব একটা অবিশ্বাসও করছে না। কেননা এর আগে এক বার ডাকাতির কেসে মুম্বই পুলিশ এসে যখন মিরশাদকে পাকড়াও করে, সে ওই ইসলামপুরেই ঘাঁটি গেড়েছিল।
মিরশাদ যে অনেক দিন ধরেই মুর্শিদাবাদে আর পাকাপাকি থাকে না, বরং মুম্বইয়ে তার কাজ-কারবার তা পুলিশ ভাল মতোই জানে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, মুম্বইয়ে বেশ কয়েকটি গ্যাংয়ের সঙ্গে চুক্তিতে কাজ করে সে। মূলত ‘মুভিং শ্যুটার’ (চলতে-চলতেই এক টিপে উড়িয়ে দিতে পারে খুলি) হিসেবেই তার নামডাক। এক-একটা ‘কাজ’-এর জন্য এক থেকে দেড় লাখ টাকা ‘সুপারি’ নেয় সে। নিজেই সে নিজেকে ‘সুপারি’ দিয়েছিল এ বার।
কেন? গল্পের শুরু বারো বছর আগে। একটা মুরগি নিয়ে বিবাদের জেরে খুন হয়েছিলেন মিরশাদের বাবা আরেজুল্লা শেখ। সেই খুনে ইয়ার আলির নাম জড়িয়েছিল। বছর দুয়েক আগে ফের খুন হয় মিরশাদের ভাই আরশেদ শেখ। অভিযোগ সেই ইয়ার আলির বিরুদ্ধেই। বদলা নিতে ছোরা হাতে তাঁর উপরে চড়াও হয় মিরশাদ। ডান কান কাটা পড়ে, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ইয়ার।
কিন্তু মিরশাদের পিস্তলের ঘোড়া যে তাঁকে খুঁজছে, বিলক্ষণ জানতেন আজিমগঞ্জগোলা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান ইয়ার আলি। কংগ্রেসের ‘দাপুটে নেতা’ বলে পরিচিত ইয়ার আলি কিছু দিন আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে, এই খুন নিয়ে রাজনীতিও শুরু হয়ে গিয়েছে। রাতে ইয়ার আলির বাড়িতে গিয়ে তৃণমূল নেতা মুকুল রায় বলেন, ‘‘জঙ্গলমহলে খুনের রাজনীতি থেমে গিয়েছে, পাহাড়ে থেমে গিয়েছে। এ সব চলবে না।’’ জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেনও সিপিএম-কংগ্রেসের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছেন। যদিও দুই দলই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে।
তল্লাটে ঘুরছে বদলার গল্পই। হামলার আগে চায়ের দোকানে ঢোকায় অল্পের জন্য বেঁচেছেন ইয়ারের ভাগ্নে হায়দার আলি সরকার। মিরশাদ যে কাছে-পিঠে ওত পেতে আছে, তা তিনি জানতেন। বলেন, ‘‘দিন কয়েক থেকে কানাঘুষো শুনছিলাম, হামলা হতে পারে। মামাকে সতর্কও করি। মামা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘ও কি আকাশ দিয়ে উড়ে এসে আমাকে মারবে?’ এই নিশ্চিন্তিটাই কাল হল!’’