Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

‘আমারও বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই’

যে দিন মেয়ে চাকু মারার কথা বলেছিল, তার ১৬ দিন পরে একরত্তি মেয়ের যৌনাঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে সনাতন বলেছিল— ‘‘ওর শরীরের বদ রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি ঝাড়ফুঁক করে দেব, ঠিক হয়ে যাবে।’’

মঙ্গলা ও সনাতন গোস্বামী

মঙ্গলা ও সনাতন গোস্বামী

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৭ ০৪:২৪
Share: Save:

ছোট্ট মেয়ে মাকে বলেছিল—‘‘বাবা আমাকে চাকু মারে!’’ মা চাকু মারার চিহ্ন খুঁজে পাননি।

সেই পাতানো বাবা, সনাতন গোস্বামীকে দেখলেই সিঁটিয়ে যেত মেয়ে। ঘুমের মধ্যে তার গোঙানির আওয়াজ পাওয়া যেত। মা যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন, শাড়ির খুঁট শক্ত করে আঁকড়ে থাকত সে। প্রতিবেশী এক বৌদি মাকে একান্তে বলেছিলেন— ‘‘তোমার মেয়ে বেশি দিন বাঁচবে না।’’ কেন, জিজ্ঞাসা করায় তিনি ভেঙে কিছু বলেননি।

যে দিন মেয়ে চাকু মারার কথা বলেছিল, তার ১৬ দিন পরে একরত্তি মেয়ের যৌনাঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে সনাতন বলেছিল— ‘‘ওর শরীরের বদ রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি ঝাড়ফুঁক করে দেব, ঠিক হয়ে যাবে।’’

দু’দিন জ্ঞান ছিল না মেয়ের। জ্ঞান আসার পরেও নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। ডান হাত ভাঙা। চোখের চারপাশে কালশিটে। কথা বন্ধ। শুয়ে শুয়ে শুধু গোঙায়। ওই অবস্থাতেও মাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দেয়নি বাবা। ১২ দিন পরে সাবসেন্টারে নিয়ে গেলে স্যালাইন লাগানোর সময়ে মেয়ে এক বার বলেছিল, ‘‘মা, আমি মরে যাব।’’

আরও পড়ুন: দেদার বিক্রি ‘মা-মাটি-মানুষ খোঁপা’

পুরুলিয়ার ওই সাড়ে তিন বছরের শিশুটি শুক্রবার ভোরে এসএসকেএম হাসপাতালে মারা যাওয়ার পরে মুখ খুলেছেন তার মা। এত দিন চুপ থাকার পরে এ দিন দুপুরে এসএসকেএমের পেডিয়াট্রিক সার্জারি ওয়ার্ডের একান্ন নম্বর শয্যায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বছর কুড়ির মঙ্গলা গোস্বামীর উক্তি— ‘‘আমি যার কাছে থাকতাম, সেই সনাতন মেয়ের শরীরে সূচ ঢুকিয়েছে। মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। বাঁকুড়ার ডাক্তাররা সব বলেছেন। সনাতনই মেরে মেয়ের হাত ভেঙে দিয়েছিল। সময়মতো ওকে পুলিশে দিতে পারিনি। ওর চরম সাজা হোক। আমারও বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই। আমাকেও সাজা দেওয়া হোক।’’

মঙ্গলা জানান, পুরুলিয়ার বোঙ্গাবাড়িতে থাকতেন তাঁরা। মা মাধুরী মহন্ত, বাবা শিবরাম মহন্ত। বাবা শিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু এক দিন হঠাৎ হারিয়ে যান। পরিবারটি ভেসে যায়। মঙ্গলার বিয়ে হয়েছিল ভোঙ্গা গ্রামের লক্ষ্মীকান্ত গোস্বামীর সঙ্গে। স্বামী তাঁকে ফেলে পালিয়ে গেলে মঙ্গলা ফিরে আসেন বাপের বাড়ি। খেতে জন খাটতেন। এক দিন বাড়িতে হাজির হয় সনাতন। পূর্বপরিচিতি ছিল না। মঙ্গলার কথায়, ‘‘মা বলল, ওর সঙ্গে যেতে। তাতে অন্তত আমি আর মেয়ে খেয়ে-পরে বাঁচব। ও আমাকে খুব ভালবাসত, আদর করত, মিষ্টি কথা বলত। কিন্তু মেয়েকে ভালবাসত না। শুধু বলত, ‘ওই মেয়ে তোর রক্ত চুষছে।’ মেয়ে যে দিন আমাকে চাকু মারার কথা বলে, সে দিন সনাতনকে জিজ্ঞাসা করি। ও বলে, কচি মেয়ে বানিয়ে-বানিয়ে বলছে। আমিও গায়ে চাকু মারার দাগ দেখতে পাইনি।’’

মঙ্গলা বলেন, ‘‘পরে বুঝেছি, আমি কাজে গেলে ও মেয়ের উপরে অত্যাচার করত। পরে বুঝি, সূচটাকেই ও চাকু মারা বলেছিল।’’ বলেন, ‘‘কত বলেছি, কিন্তু সনাতন হাসপাতালে যেতে দেয়নি। ও চেয়েছিল, মেয়ে মরে যাক। এলাকার মহিলা সমিতি এসে হুমকি দিলে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলে আমার মেয়ের সঙ্গে ও কী কী করেছে, জানতে পারি।’’ মঙ্গলা বলে, ‘‘ওকে জিজ্ঞাসা করি, কেন করলে? ও বলে, ভালর জন্য সব করেছে। খারাপ কিছু করলে পুলিশ ধরত। বলেছিল, মেয়ে সুস্থ হলে আমাদের নিয়ে বৃন্দাবন যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE