শহরে ২০০০ সালের বন্যার পর ১৪ বছর কেটে গিয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কালমন ও খড়খড়ি নদী দু’টি নিয়ে তবু টনক নড়েনি সেচ দফতর বা জঙ্গিপুর পুরসভার। চার দশক আগেও এই নদী দিয়েই বয়ে গিয়েছে গুজিরপুর দিয়ে ধেয়ে আসা ভাগীরথীর জলপ্রবাহ। আর আজ সেই নদীর জলস্রোতের পথে বাধা হয়ে গড়ে উঠেছে হাজারো ইমারত। কোথাও ইটের ভাটা, কোথাও বা সড়ক পথ। কোথাও বা অবরোধ ইট ও বাঁশের বেড়ার। শহর ছেড়েই নদীর গতিমুখ থমকে দিয়েছে গড়ে ওঠা চাষের জমিতে। ফলে শহরের সঞ্জীবনী খরস্রোতা কালমন ও খড়খড়ি আজ নেহাতই অবরুদ্ধ জলাশয় বই কিছু নয়। অথচ এই দুই নদীকে ঘিরেই বারবার আশা ও স্বপ্ন দেখেছেন শহরের মানুষ।
অতীতে একাধিক সময়ে নানা পরিকল্পনার কথা শুনিয়েছে সেচ দফতর এবং জঙ্গিপুর পুরসভা। কিন্তু নদীর গতিমুখকে অবাধ করার কোনও উদ্যোগ নেয়নি কেউই। অতীতের ভৌগলিক পথের পরিচয়ে উত্তরে ভাগীরথী নদীর জলস্রোত এসে মিশেছে রঘুনাথগঞ্জ শহরের প্রবেশপথ গুজিরপুরে কালমনের স্রোতে। শহরের পশ্চিম গা ঘেঁষে মাইল দেড়েক গিয়েই কালমন মিশেছে খড়খড়িতে। শহর ছাড়িয়ে খড়খড়ির স্রোত গিয়ে পড়েছে বাঁকি, মোগলমারি নালা পেরিয়ে গণকরের বিল ধেয়ে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে সাগরদিঘির কিসমত গাদির কাছে ফের ভাগীরথীতেই। রঘুনাথগঞ্জ শহরের বাসিন্দা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক ক্ষেমানন্দ মণ্ডলের কথায়, রঘুনাথগঞ্জ শহরের জল নিকাশির মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে এই দুই নদীর। শহরের গা ধুয়ে বয়ে যাওয়া জলই শুধু নয়, উত্তরে বর্ষায় বাঁশলৈ ও পাগলা নদীর দাপটে যখনই ভাগীরথীর জলস্ফীতি ঘটেছে, গুজিরপুর দিয়ে সেই জল আছড়ে পড়েছে কালমনে। খড়খড়ি, বাঁকির পথ ধরে উপচে আসা জল গিয়ে মিশেছে সাগরদিঘির গাদিতে ফের ভাগীরথীর বুকেই। নদীর সেই সরল যাত্রাপথ এখন আগলে দাঁড়িয়েছে বেলাগাম নির্মাণ। ফলে বিপন্ন নিকাশি। মহকুমা শহর রঘুনাথগঞ্জকে ঘিরে রেখেছে পুর্বে ভাগীরথী, পশ্চিমে কালমন ও খড়খড়ি। দু’পাশে দুই নদীর এই সহাবস্থানের ফলে ভরা বর্ষাতেও বরাবরই শহরের জনপদ ছিল যথেষ্ট নিরাপদ। একসময় নদীটি চওড়ায় ছিল প্রায় দেড়শো মিটারেরও বেশি। তাই ২০০০ সালের বন্যা রঘুনাথগঞ্জ শহরকে ব্যতিব্যস্ত করলেও সে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, নদীর দু’পাড়ে বেড়েছে কলোনির সংখ্যা। কলোনির বসতি যত বেড়েছে নদীর চওড়া বুক ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে কোথাও ৪০ মিটার, কোথাও বা আরও কম। জঙ্গিপুর মহকুমা আদালত চত্বর পর্যন্ত কালমনের বুক চিরেই গড়ে উঠেছে দু’টি ইটভাটা, চালকল। যে যেমন পেরেছে নদীকে আটকে দিয়ে গড়ে তুলেছে অজস্র পুকুর, ইমারত।
বেসরকারি সংস্থার এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, সাংসদ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ২০০৮ সালে এই দুই নদীকে ঘিরে ৩৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল। তাতে এই দুই নদীকে দুভাবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রথমত, রঘুনাথগঞ্জ শহরের বাড়তি জলের নিকাশি, দ্বিতীয়ত, নদীর দু’পাড় সুরক্ষিত করে বাঁধিয়ে সেখানে নিয়মিত ভাবে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা। শুধুমাত্র এই নদীর শহর ঘেঁষে থাকা ৩ কিলোমিটারের জলাশয় থেকে যে পরিমাণ মাছের জোগান মিলবে, তাতে রঘুনাথগঞ্জের মতো দু’তিনটি শহরের মাছের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। যতদূর জানি, এই প্রকল্প জমাও দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় সেচ মন্ত্রকের কাছে। কিন্তু তারপর আর সে প্রকল্প নিয়ে এগোয়নি কেউই।