Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জহুরাদের দিনরাত্রি

আঁকাবাঁকা লাইনটার শেষ মাথায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে জহুরা বিবি, সেখানে একটা বাজ পড়া তালগাছ খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া-টায়ার বালাই নেই। নিম-কাঁঠাল আর বহড়া গাছের ছায়াগুলোর কোলে লাইনটা চাক বেঁধে থাকলেও জহুরার মাথার উপরে বধির রোদ্দুর।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০১:৫৪
Share: Save:

গ্রামীণ মেডিক্যাল ক্যাম্প।

আঁকাবাঁকা লাইনটার শেষ মাথায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে জহুরা বিবি, সেখানে একটা বাজ পড়া তালগাছ খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া-টায়ার বালাই নেই। নিম-কাঁঠাল আর বহড়া গাছের ছায়াগুলোর কোলে লাইনটা চাক বেঁধে থাকলেও জহুরার মাথার উপরে বধির রোদ্দুর।

ক্যাম্পের শামিয়ানাটা দেখা যাচ্ছে অশ্বত্থের নরম ছায়ায়। খান পাঁচেক টেবিল, সার দিয়ে জলের বোতল, নরম তোয়ালে, বেঁটে পর্দা ঠেলে মেয়েরা সেই ক্যাম্পে সেঁদিয়ে গেলে কেউ মিনিট পাঁচ কারও বা ঝাড়া পনেরো মিনিট। পরীক্ষার পরে গাঢ় মুখে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরছেন কেউ, কারও ঢলে ঢলে সে কি হাসি।

জহুরা জানে বাড়ি ফেরার আগে আরও অন্তত ঘণ্টাখানেক তাকে এই ছায়া-রোদ্দুরের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলতে হবে।

এই সব ক্যাম্পে আসার কোনও ইচ্ছেই হয় না জহুরার। সাত বছর বিয়ে হয়েছে তার। ছানাপোনা নেই। তা নিয়ে শ্বশুরবাড়ির বিস্তর বল্লমের খোঁচার পরে বর যখন তালাক দেওয়ার তোড়জোর করছে, সে বছরই সন্তানসম্ভবা হয়েছিল সে। তবে বাচ্চা টেঁকেনি। সেই থেকে পাড়ায় ব্রাত্য সে।

তবু, এ বার জোর করেই তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে ওই লাইনে। দেড় হাত আঁচল টেনে লাইনে গোমরা মুখে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল, শুধু সন্তানের মা হওয়াই বুঝি পরিচয়! তার কষ্ট-মনখারাপ-বিষন্নতা— না তা নিয়ে ভাবার কেউ নেই।

মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক গ্রামে সে সবের তোয়াক্কা করারও কেউ নেই। তবু, সে দিন শহর থেকে আসা দিদিদের কথায় বড় মন ভরেছে তার। গাছের ছায়ায় এক ঝাঁক মেয়ে-বৌয়ের সামনে শহুরে দিদিরা যখন স্পষ্ট করে দিল, মেয়েদের পরিচয় শুধু সন্তানের মা নয়, তাদের কাজই তাদের পরিচয়। কিন্তু সে কথা শুনে সামনে কেউ আপত্তি না তুললেও পরে সে কি কূটকাচালি। জহুরা এই সব আলোচনায় থাকে না। তবু গরম হল্কার মতো সে সবই তার কানে ঢুকছিল। না ঢুকে উপায় কি, ঘর-বাহির সর্বত্রই মেয়েরা বুঝি এই একক পরিচয় নিয়েই তাঁদের সাফল্য হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।

পরিচিত ঐতিহাসিক এবং লেখক জেরাল্ডিন ফোবস তাঁর ‘উইম্যান ইন মর্ডান ইন্ডিয়া’ বইয়ে এ বিষয়ে চমৎকার এক শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন, ‘নেক টু নি’— অর্থাৎ মেয়েদের পরিচিতি শরীরের ওই নির্দিষ্ট এলাকাটুকুর মধ্যেই।

সন্তান ধারন তাকে মানুষ করা তার পর অন্য সকলের কাছে তার নিজের মনের হদিসটুকু খুইয়ে নিতান্তই একটা সন্তান উৎপাদক যন্ত্র হয়ে থেকে যাওয়া।

এ ছাড়া তাঁদের যেন সমাজে বিশেষ কোনও প্রয়োজনীয়তাই নেই! নারী দিবসে সে প্রশ্নটাই যেন গ্রাম বাংলার প্রান্তসীমায় তুলে দিলেন জহুরা বিবিও। ক্যাম্পের দীর্ঘ লাইনে বিরক্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার আগে তাই সে বিড়বিড় করে, ‘‘আমারু একডা মন আছিল, ছিল শখ-আল্লাদ, সেই মনডার খোঁজ কে রাখে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day Geraldine Forbes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE