পাঁচ মাতব্বর এখনও পুলিশের নাগালের বাইরে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে আরও কিছু নাম।
শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মামলা লঘু করার চেষ্টা করছে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত। ঠারেঠোরে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে যাতে মামলা তুলে নেওয়া হয়।
পরপুরুষের সঙ্গে ঘর ছাড়ায় সালিশি সভা বসিয়ে যাঁর চুল কেটে নেওয়া হয়েছিল, লোকলজ্জায় সেই তরুণী বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
যে মাতব্বরদের পুলিশ এখনও ধরতে পারেনি, তারা হল সাহাবুদ্দিন শেখ, হামিদুল শেখ, রহুল শেখ, প্রতিকূল শেখ ও রেজাউল শেখ। এ ছাড়া তরুণীর এক নিকটাত্মীয় জড়িত ছিলেন বলে পুলিশ জেনেছে। নাম জড়িয়েছে হামিদুলের ছেলেরও। এই হামিদুলই তরুণীকে ১০৮ ঘা কঞ্চির বাড়ি মেরেছিল বলে গ্রামের লোকেরা পুলিশকে জানিয়েছেন।
রবিবার রাতে নওদার চাঁদপুর গ্রামে তরুণীর বাড়ির সামনেই ওই সালিশি সভা বসেছিল। কারণ? দিন বারো আগে হতদরিদ্র পরিবারের ওই তরুণী স্বামী ও ছেলেমেয়েদের ছেড়ে গরু-ছাগলের এক কারবারির সঙ্গে নতুন করে সংসার পাততে চলে গিয়েছিলেন। লোকটি বিবাহিত। নদিয়ার তেহট্টে তার পরিবার রয়েছে। দুর্গাপুরে কয়েক দিন কাটিয়ে দু’জনে সেখানে যাওয়া মাত্রই অশান্তি শুরু হয়। বাধ্য হয়ে তরুণী বাড়ি ফিরে আসেন। ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে স্বামী তাঁকে ফিরিয়েও নেন।
কিন্তু তুষে আগুন লাগানোর লোকের অভাব নেই। গাঁয়ের কিছু লোক এবং তরুণীর এক আত্মীয়ের চাপে সালিশি সভা বসে। গ্রাম সূত্রের খবর, তরুণীর সেই নিকটাত্মীয়ই ছিলেন অন্যতম হোতা। মোড়লেরা ঘোষণা করে, পরপুরুষের সঙ্গে চলে যাওয়ার অপরাধে তরুণীটিকে ১০৮ ঘা কঞ্চির বাড়ি মারা হবে। ছ’হাজার টাকা ‘জরিমানা’ও দাবি করা হয়, যা আসলে তোলাবাজিরই নামান্তর। তা দিতে পারবেন না বলে জানানোয় তরুণীর স্বামীকে ধরে পেটানো হয়। তাতে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না দেখে মোড়লেরা ফতোয়া দেয়, তরুণী যাতে রূপ দেখিয়ে আর কাউকে ভোলাতে না পারেন, তার জন্য তাঁর চুল ছেঁটে দিতে হবে। তাঁর স্বামীকেই সেই কাজে বাধ্য করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, পুলিশের কাছে গেলে পরিণতি আরও খারাপ হবে বলে তরুণী আর তাঁর স্বামীকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কানাঘুষোয় খবর পেয়ে বুধবার নওদা থানার পুলিশ দম্পতিকে থানায় নিয়ে আসে। এর পরেই তরুণী আট জনের নামে লিখিত অভিযোগ জানান। তবে নিকটাত্মীয়ের নাম দেননি। এখনও পর্যন্ত তিন জনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ। বাকিরা জলঙ্গি টপকে কৃষ্ণনগর বা তেহট্টে চলে গিয়ে থাকতে পারে বলে তাদের সন্দেহ।
এ দিন চাঁদপুরে গিয়ে দেখা যায়, বারবার পুলিশ আসায় ভয়ে অনেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যে জনা পঞ্চাশ লোক সে দিন সালিশি সভায় হাজির ছিলেন, ভয়ে আছেন তাঁরাও। ফেরার অভিযুক্তদের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে কেউ এড়িয়ে গিয়েছেন, কেউ উল্টে কারণ জানতে চেয়েছেন। শেষে ছবি তোলা যাবে না এই শর্তে এক জন হামিদুলের বাড়ি দেখিয়ে দেন। একটি পুকুরের পাড়ে সাদা বাড়িটিতে তালা ঝুলছে। সেখান থেকে একটু এগিয়ে সাহাবুদ্দিন শেখের রং না করা দোতলা বাড়ির দরজাতেও তালা। কবে থেকে তারা বেপাত্তা হয়েছে, তা গাঁয়ের কেউই জানাতে পারেননি।
স্থানীয় সূত্রের দাবি, ঠিকাদার সাহাবুদ্দিন আড়ালে থাকলেও লোক মারফত তরুণীকে মামলা তোলার জন্য চাপ দিচ্ছে। টাকার লোভও দেখানো হচ্ছে। এমনকী শাসক দলের একাধিক গোষ্ঠীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে সে। তবে নওদা ব্লক তৃণমূল সভাপতি ও স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জুলফিকার আলি ভুট্টো বলেন, ‘‘হুমকি দেওয়া হচ্ছে কি না, খোঁজ নিচ্ছি। যদি তা সত্যি হয়, তবে আমরাই তার প্রতিবাদ করব।’’
এ দিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তরুণীর স্বামী বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার বহরমপুর থেকে ফিরে আমার স্ত্রী লোকলজ্জার ভয়ে নওদার শ্যামনগরে বাপের বাড়িতে গিয়েছে। ছেলেমেয়ে থাকায় সকালে আমি বাড়ি ফিরেছি।’’ কেউ হুমকি দিচ্ছে বা টাকার লোভ দেখাচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy