Advertisement
E-Paper

গাঁজা আসছে না আর মণিপুর থেকে, এখন ‘বঙ্গদেশের’ মাদক চাহিদা মেটাচ্ছে প্রাচীন সেই কলিঙ্গ

কালীগঞ্জের ছোট নলদহ, বড় নলদহ, সাহেবনগর বরাবরই মাদক কারবারিদের ‘মুক্তাঞ্চল’ বলে পরিচিত জেলায়। মূলত উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে রেল ও সড়ক পথে মাদক এসে পৌঁছত মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায়।

প্রণয় ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৩ ২১:০৩

—প্রতীকী ছবি।

গত দু’-তিন দিন ধরেই বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে দেশি মুরগি। দেড় কেজি ওজনের গঙ্গার ইলিশও বিক্রি হচ্ছে নিলামে। এক-একটার দাম উঠছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। সেই রকমই একটি ইলিশ নিলামে ২৬০০ টাকায় কিনে বাড়ির পথে রওনা দিলেন স্থানীয় এক ভ্যানচালক। পরনে কুঁচকে যাওয়া লুঙ্গি আর ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি। মাসদেড়েক বাদে এই বিষ্ণু দাস (নাম পরিবর্তিত)-কে বাজারে দেখেই পুরনো গুঞ্জন ভেসে উঠেছে লোকমুখে— ‘বোধহয় বস এসেছে’!

নদিয়ার কালীগঞ্জে শুধু ওই বাজারেরই ভোল পাল্টায়নি, খুলতে শুরু করেছে দীর্ঘ দিন ধরে ঝাঁপ বন্ধ থাকা গুমটিগুলিও। কোনওটা চায়ের দোকান, কোনওটা আবার মনিহারি। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, এই দোকানগুলির আড়ালেই নাকি এতকাল মাদকের রমরমা ব্যবসা চলেছে! যে মাদক আসত মণিপুর থেকে। গাঁজা থেকে হেরোইন— বাদ যেত না কিছুই। কিন্তু গত মাস দুয়েক ধরে ওই রাজ্যে গোষ্ঠীহিংসার জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাদকের আমদানি। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বাজার সংলগ্ন এলাকার এই সব দোকান। স্থানীয় সূত্রে দাবি, সেই কারবার আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। খবরও রটে গিয়েছে, এখন নাকি ওড়িশা থেকে ঢুকছে মাদক!

দু’দিন ধরে ‘বসেদের’ অর্থাৎ কারবারের মাথাদের আসার খবর ভাসতে থাকায় আবার যেন সেই পুরনো ব্যস্ততা ফিরে এসেছে কালীগঞ্জ বাজার এলাকায়! দোকানে চা খেতে খেতে এলাকার বাসিন্দা অসীম মণ্ডল বলছেন, ‘‘বসেরা এলেই কিছু লোকের পকেট ফুলেফেঁপে ওঠে। কাঁচা টাকা ওড়ে বাজারে! রাতবিরেতে এলাকায় বড় বড় গাড়ি ঢোকে। বহিরাগতদের আনাগোনা বাড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত মদ-মাংসের মোচ্ছব চলে এলাকায়।’’ হাসতে হাসতে পাশে বসা ভোলানাথ সাহার টিপ্পনি, ‘‘বাজারে যারা মাছ, মাংস বেচে, এই সময়ে সব চেয়ে লাভ তো ওদের!’’

কালীগঞ্জের ছোট নলদহ, বড় নলদহ, সাহেবনগর বরাবরই মাদক কারবারিদের ‘মুক্তাঞ্চল’ বলে পরিচিত জেলায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মূলত উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে রেল ও সড়ক পথে বিভিন্ন ‘পয়েন্ট’ ধরে মাদক এসে পৌঁছত মালদহ ও মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায়। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ত নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায়। আবার মণিপুর থেকে সরাসরি নবদ্বীপ হয়েও উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, মধ্যমগ্রাম এবং কলকাতায় পৌঁছে যেত মাদক। কিন্তু সম্প্রতি মণিপুর অশান্ত হয়ে ওঠায় সেই কারবারে এখন ভাটা পড়েছে। তার উপর এসটিএফ আর পুলিশের লাগাতার যৌথ অভিযান! গত দু’মাসে গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন বহু কারবারি। পুলিশি তল্লাশিতে উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকার মণিপুরী মাদক। গ্রেফতারও হয়েছেন জনা ছয়েক। এই পরিস্থিতিতে ঘুরপথে মাদক ঢুকছে বাংলায়।

নলদহে মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্ত একাংশের দাবি, সম্প্রতি গাঁজা পাচারের চেনা রুট বদলাচ্ছেন পাচারকারীরা। অসম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্যের গাঁজার চাহিদা বাংলায় বেশি। কিন্তু তার জোগান এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মণিপুরে গোষ্ঠীহিংসার কারণে ওই রুটের একাধিক জায়গায় পুলিশ, আধাসেনার টহলদারি জোরদার হয়েছে। ৪১টিরও বেশি নতুন নাকা পয়েন্ট পেরিয়ে পৌঁছতে হচ্ছিল বাংলায়। পুলিশের ঝক্কি এড়াতেই এখন ওড়িশার কলিঙ্গ থেকে মেদিনীপুর হয়ে ঘুরপথে গাঁজার আমদানি হচ্ছে। কলিঙ্গ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য। তারই কিছুটা অংশ এখন ওড়িশার মধ্যে পড়ে। গোদাবরী ও মহানদীর মধ্যবর্তী এই উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রাচীন কালে মশলার আসত বঙ্গদেশে। এখন মাদক আসে! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদক কারবারির কথায়, ‘‘ওড়িশার গাঁজা মণিপুরের থেকে ভাল। দামও একটু বেশি। তাই বিক্রি একটু কম। যত দিন না মণিপুরের অবস্থা শান্ত হচ্ছে, তত দিন ওড়িশার মাল দিয়েই কাজ চালাতে হবে। লাভ কম হলেও, উপায় নেই।’’ আর এক কারবারির কথায়, ‘‘পুলিশের অত্যাচারে ব্যবসা প্রায় গুটিয়ে দিয়েছিলাম। বসেরাও খুব একটা ঝুঁকি নিতে চাইত না। কারবার দাঁড় করাতে আবার দিনরাত কাজ করছি আমরা।’’

মাদক কারবারিদের বদলে ফেলা রুট সম্পর্কে খোঁজখবর করা শুরু করেছে পুলিশও। সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে জেলার একাধিক সীমান্ত এলাকায়। এই প্রসঙ্গে জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার ভিজি সতীশ বলেন, ‘‘মাদক পাচার রুখতে যথেষ্ট সক্রিয় জেলা পুলিশ। সমস্ত সোর্স অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করে একাধিক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযানও চলছে।’’ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সক্রিয় হচ্ছে বিএসএফ। বাহিনীর দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি একে আর্য বলেন, ‘‘সীমান্তে মাদক পাচার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। বিএসএফ সমস্ত ধরনের মাদক কারবার শূন্যে নামিয়ে আনতে চাইছে।’’

Ganja farakka Kaliganj Nadia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy