সবে সন্ধ্যা নেমেছে। এক হাতে তেলেভাজা। অন্য হাতে বিড়ি। মরা নদীর ব্রিজের রেলিংয়ে বসে খিটখিটে চেহারার দুই যুবক খানিকটা উদাসীন হয়ে সুখটান দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আলুর চপে কামড় বসাচ্ছে। আধ খাওয়া চপটা উল্টে-পাল্টে দেখছে দু’জনই। আচমকা একজন খানিকটা আপন খেয়ালেই বলে উঠল, ‘‘এবার মনে হচ্ছে এই শিল্পটাকেই বেছে নিতে হবে। মানে তেলেভাজা শিল্পটাকেই। আমাদের শিল্পের যা মন্দাদশা। ভরা ভোটের মরসুমে কোনও কাজ নেই!’’ শিল্পে মন্দা বলতে কোনও নির্মান শিল্প নয়। এ হল ডোমকলের ‘বোমা-শিল্প।’ ফি ভোটের মাস খানেক আগে থেকে এই শিল্পের বাজার থাকে তুঙ্গে। সব রাজনৈতিক দলই বোমা ‘শিল্পীদের’ কাজের বরাত দেয়। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ‘শিল্পী’রা মোটা টাকার বিনিময়ে বোমা বাঁধে। কিন্তু এ বার চিত্রটা বিলকুল বদলে গিয়েছে। পুলিশ-বাহিনীর যৌথ দাপাদাপিতে বোমা ‘শিল্পীদের’ কপালে বরাত মিলছে না।
রাজ্যে ভোট-হিংসার মানচিত্রে ডোমকলের স্থান সব সময় উপরের দিকে থাকে। ঝামেলাহীন ভোট ডোমকল খুব কমই দেখেছে। আর সমস্ত ভোট-সন্ত্রাসেই মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয় বোমা। ভোটের মাস তিনেক আগে থেকেই জেলার ডোমকল, কান্দি, রেজিনগর, হরিহরপাড়ায় শুরু হয় যায় বোমা বাঁধা। তবে জেলার মধ্যে ডোমকলের বোমা তৈরির কারিগরদের কদর যেন একটু বেশিই। ভোটের মুখে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের ডাক পড়ত। প্রতি রাতে বোমা বাঁধার জন্য মজুরিও মিলত বেশ চড়া। এক রাতে কমপক্ষে হাজার চারেক টাকা পেত কারিগররা।
কিন্তু সে সব এখন অতীত হল কী করে? বোমা কারবারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোটের অনেকটা আগেই চলে এসেছে। শুধু তাই নয়, এলাকায় আনাচে-কানাচে উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে বাহিনীর জওয়ানরা। আর তাতে ঝোপঝাড় থেকে বিস্তর বোমাও মিলছে। ভোটের আগে এত বোমা উদ্ধারের ধুম দেখে নতুন করে আর কেউ বোমা তৈরির সাহস দেখাচ্ছে না। এক বোমার কারবারির কথায়, ‘‘দুই এক জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বোমা তৈরি চলছে। তাই তা পরিমানে খুবই কম। মোটের উপর এ বার ভোট মরসুমে বোমা ব্যবসার বেহাল দশা।’’
বাজার অর্থনীতির সরল সূত্র মেনে তাই বারুদের দামও কমছে। কারণ, বোমাই আর সে ভাবে তৈরি হচ্ছে না। ডোমকলের এক বারুদ বিক্রেতা জানাচ্ছেন, বছরের শুরুতেই কালো বারুদের বিকোচ্ছিল কেজি প্রতি ৩ হাজার টাকায়। আর বোমা তৈরির উৎকৃষ্ট কাঁচামাল বিকোচ্ছিল কেজি প্রতি প্রায় ৪ হাজার টাকায়। চড়া ছিল বোমা তৈরির কারিগরদের পারিশ্রমিকও। বছরের অন্যান্য সময়ে যেখানে দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকার আশপাশে থাকে, সেখানে মজুরি দাঁড়ায় প্রায় হাজার টাকা। পাকা কারিগররা প্রতি রাতে পাচ্ছিলেন প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা। আর শিক্ষানবিশরা প্রতি রাতে পাচ্ছিলেন ৫০০ টাকা। কিন্তু বাহিনীর কড়াকড়িতে সে আয়ে ভাটা পড়েছে। কার্যত বেকায় হয়ে পড়েছেন তারা। আর পড়তির দিকে বারুদের দামও। এখন কালো বারুদ প্রতি কিলোগ্রাম ১২০০ টাকার বিক্রি হচ্ছে। আর এক কেজি লাল বারুদের দাম কমে হয়েছে ১৬০০ টাকা। এক বারুদ কারবারি জানালেন, অনেকে ফোন করে বারুদের খোঁজ করলেও পরে আর আসছে না। মনে হচ্ছে শেষমেশ মশলা নদীতে ফেলে দিতে হবে। ডোমকলের এক বোমা বাধার ওস্তাদের কাছে মন্দার কারণ জানতে চাইলে বিরক্তি ভরে সে বলে, ‘‘আরে মশাই ভোটের হাওয়া উঠতে না উঠতেই উড়ে এল বাহিনী। আর এসেই বাড়ি বাড়ি তল্লাশি শুরু করছে। বাদ রাখছে না জঙ্গল, বাগান, কবরস্থান।’’ বাহিনী ওদের কাজ করছে, তাতে আপনাদের কি? পাশে বসে এক বন্ধু প্রশ্ন করলেন। আরও বিরক্তি প্রকাশ করে সে বলল, ‘‘আরে ওদের জন্যই তো বাইনা বন্ধ ওস্তাদের। গত ১৫ দিনে এক নাইটেও ডাক পাইনি। মনে হচ্ছে গোটা সিজিনটা মাঠে মারা যাবে। ভরা মরসুমে এমন হলে কার ভাল লাগে বলুন।’’ তবে এই আকালেও অনেক বোমার কারবারিরা আশার আলো দেখছেন। তাঁদের দাবি, ‘‘শেষ মুহূর্তে আবার বাজার চাঙ্গা হবে। তখন সুদে আসলে দাম তুলে নেব। ৫ হাজারের বারুদ ১০ হাজারে ছাড়ব।’’ যদিও জেলা প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, সেই সুযোগ আসবে না। কমিশনের নজরদারি উল্টে আরও বাড়বে। তবে প্রশাসনের চিন্তা অবশ্য পুরো কাটছে না। জেলা পুলিশের এ কর্তা বলছেন, ‘‘মাস তিনেক আগের তৈরি সব বোমা তো আর উদ্ধার হয়নি। ভোটের দিন সেই ব্যবহার হলেই মুশকিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy